স্টাফ রিপোর্টার: বিভিন্ন পর্যায়ে থেমে আছে ৩৩৭ হাইপ্রোফাইল দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হিসেবে প্রত্যাহারের জন্য বিবেচনাধীন রয়েছে- এ ধরনের সনদ নিয়ে স্পর্শকাতর এসব মামলার ভিআইপি আসামিরা ভোগ করছেন এক ধরনের আনুকূল্য। হয়রানিমূলক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ আইনে না থাকলেও বিষয়টি স্পষ্ট করছে না দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকও। প্রত্যাহার না হলেও কোন উদ্দেশে মামলাগুলো প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। এর ফলে দুর্নীতিবাজরা শাস্তির বদলে পুরস্কৃত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে টিআইবি। ২০০৯ সালের ১০ জুন থেকে প্রত্যাহার কমিটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ শুরু করে। গত পাঁচ বছর এ কমিটি ৩১টি বৈঠক করে। গত বছর ২২ আগস্ট প্রত্যাহার কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে ৭ হাজার ১৭৩টি মামলা আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। মামলাগুলোর মধ্যে ৩৩৭টির বাদী দুর্নীতি দমন কমিশন।
সুপারিশকৃত মামলাগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি আলহাজ মকবুল হোসেন, প্রশিকার প্রধান নির্বাহী কাজী ফারুক আহমেদ, কামাল আহমেদ মজুমদার এমপি, আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপিসহ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা আসামি। এর মধ্যে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো হাইকোর্ট থেকে কোয়াশমেন্ট (অব্যাহতি) হয়েছে। বাকিদের মামলা বিভিন্ন আদালতে এখনও বিচারাধীন।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন থাকলেও মামলাগুলোর কার্যক্রম এখন স্থগিত। কোনোটি মামলা দায়েরের বৈধতা চ্যালেঞ্জ, নোটিশ প্রদানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ, মামলা রুজুর প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ, উচ্চ আদালতের নির্দেশসহ বিভিন্ন কারণে মামলাগুলোর কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। স্থগিত অবস্থা থেকে উত্তরণ কিংবা উচ্চ আদালতের আদেশ রদ (ভ্যাকেন্ট) করার উদ্যোগ নিচ্ছে না দুদক। হয়রানিমূলক বিবেচনায় প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে- এমন কারও মামলা গত পাঁচ বছরে নড়চড়া করেনি। অভিযোগ রয়েছে, দুদকে মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য পাঠানো হয়েছে- এমন সুপারিশ সংবলিত তালিকা অভিযুক্তদের আইনজীবীরা দাখিল করছেন আদালতে। দুদকের পক্ষ থেকেও হাইপ্রোফাইল মামলাগুলোর কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার নেই তেমন উদ্যোগ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলীয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় দুদক যেমন অস্বাভাবিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করছে, তেমনি হাইপ্রোফাইল মামলার সরকারদলীয় আসামিরা দুদকের কাছ থেকে পাচ্ছেন এক ধরনের আনুকূল্য।
প্রত্যাহারের সুযোগ নেই: রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় দুদকের পক্ষে কোনো মামলা দায়ের কিংবা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন খোদ দুদকের প্যানেল আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ অনুযায়ী মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ দুদকের নেই। আইনের ৩২ ধারায় এফআইআর দায়েরের আগে কমিশনের অনুমোদন নেয়ার কথা বলা আছে। মামলা করার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে- মর্মে সন্তুষ্ট হয়েই কমিশনকে এ অনুমোদন দিতে হয়। একইভাবে চার্জশিট দাখিলের ক্ষেত্রেও অনুমোদন নিতে হয় কমিশনের। চার্জশিট দাখিলের সময় নথির সঙ্গে কমিশনের অনুমোদন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও সংযুক্ত করতে হয়। এখন যে মামলাটি কমিশন সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে মর্মে সন্তুষ্ট হয়ে রুজু করল সেই মামলাটি সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই মর্মে কি করে প্রত্যাহার করে নেবে? তিনি বলেন, ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৮ এ মামলা প্রত্যাহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রত্যাহার প্রশ্নে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সাথে এ আইন সাংঘর্ষিক। এ দুটি আইনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট-১৯৫৮ এর মামলা দায়েরের পর সেটি তদন্ত করে পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থা। কিন্তু দুদকের মামলা দুদকই অনুসন্ধান ও তদন্ত করে চার্জশিট দেয়। অর্থাৎ দুদক নিজেই এখানে প্রসিকিউটর। মামলা প্রত্যাহার করে নিজের তদন্তকে নিজেই মিথ্যা বলতে পারে না।
খুরশিদ আলম খান বলেন, দণ্ডবিধির মামলায় সাক্ষী ও প্রমাণভিত্তিক। কিন্তু দুদকের মামলা প্রমাণভিত্তিক। এখানে সাক্ষী মুখ্য নয়। একজন সাক্ষী পাওয়া গেলে তাতেই বিচার চলতে পারে। এ মামলায় প্রমাণাদিই কথা বলবে। প্রমাণ না থাকলে তো কমিশন মামলাই অনুমোদন দিতে পারে না। ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট ১৯৫৮ অ্যাক্ট আর এন্টি করাপশন কমিশন অ্যাক্ট যখন সাংঘর্ষিক হবে তখন এন্টি করাপশন কমিশন অ্যাক্টই প্রাধান্য পাওয়ার কথা বলা আছে। তিনি বলেন, দুদকের একটি মামলায় কমিশন একাধিকবার মামলার সঠিকতা নিশ্চিত করে। প্রথমত, অনুসন্ধান, অনুসন্ধানে সন্তুষ্ট হয়েই এফআইআর রুজু করতে অনুমোদন দেয় কমিশন। দ্বিতীয়ত, তদন্ত। তদন্তে প্রমাণাদি নিশ্চিত হয়ে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেয়। এসব প্রক্রিয়া অতিক্রম করে মামলাটি যখন ট্রায়ালে যাবে তখন দুদক কিভাবে বলবে যে, অনুমোদনগুলো ভুল ছিলো? দুদক তো কোনো ব্যক্তি নয়-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সব সময় এক হতে হবে।
অবস্থা স্পষ্ট করছে না দুদক: মামলা প্রত্যাহার কমিটি ৩১ দফায় দুদকে মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য পাঠায়। দুদকের সে সময়কার চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মামলাগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। কালক্ষেপণের কৌশল নিয়ে বলেছিলেন, প্রত্যাহারের আবেদন করা হলেই যে প্রত্যাহার করা হবে- এমন ধারণা ঠিক নয়। আমরা প্রত্যাহারের আইনগত বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এখন অবধি সুপারিশ আসা শেষ হয়নি। সম্পূর্ণ তালিকা পেলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এরই মধ্যে চার বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে অবসরে চলে যান তিনি। দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান মো. বদিউজ্জামান। তবে বর্তমান কমিশনও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষ্কার করেননি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে পাঠানো মামলাগুলোর অবস্থা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার কমিটি আমাদের ৪শ জনের বেশি একটি তালিকা দিয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো মামলা প্রত্যাহার করিনি। কারণ দুদক আইনে মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই।
মামলাগুলোর ব্যাপারে দুদকের এ সিদ্ধান্তহীনতার ফলে আসামিরা বিশেষ কোনো সুবিধা নিচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আসামিরা বললেই তো সেটি কোর্ট গ্রহণ করবে না। বরং আমরা মামলাগুলো প্রত্যাহার না করায় কোনো কোনো আসামি উচ্চ আদালত থেকে মামলাগুলোর ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। আমাদের ওপর নির্ভর করতে না পেরেই আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ আইনে নেই- এ কথা দুদক স্পষ্ট করে বলছে না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো এটি বলছিই।
দায় নেই প্রত্যাহার কমিটিরও: দুদক আইনে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের ও প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ না থাকলেও একের পর এক প্রত্যাহারের সুপারিশ সংবলিত মামলা পাঠিয়েছে প্রত্যাহার সংক্রান্ত কমিটি। বিগত সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ওই কমিটি ৩১টি সভা করে। সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকতেন। জেলা কমিটি, কেন্দ্রীয় বাছাই কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায় সম্পন্ন করে প্রত্যাহারের সুপারিশের জন্য মামলা আসতো কমিটির হাতে। এ কমিটি ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধি, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনসহ বিভিন্ন আইনে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। সুপারিশকৃত মামলার তালিকায় দুর্নীতি দমন কমিশন দায়েরকৃত মামলা ছিলো দেড় হাজারের বেশি। এর মধ্য থেকে ৩৩৭টির মতো মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। যার প্রায় ৯৫ ভাগই ছিলো সরকারদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ৩১ দফায় পাঠানো এসব মামলার বিষয়ে এখন অবধি কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দায় এড়িয়ে যান কমিটির সভাপতি বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। আইনে না থাকলেও কেন, কোন উদ্দেশে মামলাগুলো প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেছি। দুদক যদি মামলাগুলো প্রত্যাহার না করে সেটি দুদকের বিষয়। মামলাগুলোর কার্যক্রম যদি না চলে সেটির জন্য দুদকই জবাবদিহি করবে। আমাদের কাজ ছিলো প্রত্যাহারের সুপারিশ করার, সেটি করেছি। এরপর আমাদের কিছু করার নেই।
অন্যায় হচ্ছে: দুদকে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে- এ প্রেক্ষাপটে মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়লে সেটি অন্যায় বলে মন্তব্য করেছেন ব্যারিস্টার রফিক উল হক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, দুদকে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে তো বহু আগে। সেটি যদি এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে থাকে এবং এ কারণে যদি মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় শৈথিল্য দেখায় তাহলে এটি অন্যায় হচ্ছে। মামলাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। অভিযোগের সাথে যদি সম্পৃক্ততা না থাকে তাহলে তারা আদালতেই খালাস পাবেন।
একই বিষয়ে আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আমার কাছে যেটি মনে হয়েছে, মামলা প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে- জাতীয় কথাবার্তা বলে কালক্ষেপণ সরকারের সোথে দুদকের বোঝাপড়ারই অংশ। এ কারণে প্রত্যাহার কমিটির সুপারিশকৃত মামলাগুলো চালু করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎপরতা ততোটা লক্ষণীয় নয়। ফলে দুদকের এ গা-ছাড়া ভাবের পূর্ণাঙ্গ সুযোগটি গ্রহণ করছেন মামলায় অভিযুক্তরা। তারা এখন আর দুর্নীতি মামলার ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধিরও প্রয়োজন মনে করছেন না। যেহেতু প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে তাই মামলাটি আপাত সচল হচ্ছে না- এ নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছেন।
দুদক ও সরকার শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করছে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, এটির দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে বিচার বিভাগ রয়েছে সেখানে আদালতের বাইরে মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত আদালত অবমাননার শামিল। তারা যদি দুর্নীতি না-ই করে থাকবেন তাহলে তো আদালতের মাধ্যমেই সেটি প্রমাণ করা সম্ভব। মামলা প্রত্যাহার করতে হবে কেন?
দ্বিতীয়ত, দুদকের নেতৃত্বের দৃঢ়তার অভাব রয়েছে। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে একটা কিছু এলেই তারা এটি নিয়ে বসে থাকে। দুদক আইনে মামলা প্রত্যাহার করার কোনো সুযোগ নেই- এ কথাটি তারা পরিষ্কার করে বলছে না কেন? কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার ফলে তো দুর্নীতিবাজরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার এবং দুদক উভয়ের কারণে দুর্নীতিবাজরা শাস্তির বদলে পুরস্কৃত হচ্ছে। ক্ষমতাবানদের মাঝে দুর্নীতিপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।