ময়মনসিংহের ত্রিশালে গত রোববার প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমাহামলা চালিয়ে জঙ্গি মামলার তিন আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তা যেন কোনো অ্যাকশন সিনেমার দুর্ধর্ষ দৃশ্যের চিত্রায়ণ। পুলিশ জানিয়েছে, ছিনতাই হওয়া তিন আসামিই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সাথে সম্পৃক্ত। তাদের মধ্যে জেএমবির শীর্ষ সন্ত্রাসী সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সজীব ও রাকিব হাসান হলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। আরেকজন বোমা মিজান ৪০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ঘটনার সময় নিহত হন এক পুলিশ সদস্য। তিন আসামির একজনকে ঘটনার ছয় ঘণ্টার মধ্যে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতারও করা হয়। গতকাল সোমবার ভোরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে পুলিশের সাথে ‘বনন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।
প্রিজনভ্যানে হামলাকারীদের ও অন্য দু আসামির দেশত্যাগ রুখতে সীমান্তে জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। এমনকি তাদের ধরিয়ে দিতে ইতোমধ্যে পুলিশ পুরস্কার ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় কারাগারে জেএমবির সাজাপ্রাপ্ত শতাধিক নেতাকর্মী রয়েছে বিধায় সেখানেও জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সাধারণত যে ধরনের সতর্কতা নেয়া হয়, এসব সেই রুটিন ব্যবস্থার অংশ বলা যায়।
কিন্তু আমাদের দুশ্চিন্তা অন্যত্র। এ ধরনের ভয়ঙ্কর আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বিবিধ কারণে আমাদের ললাটদেশে চিন্তার ছাপ ফেলে দেয়। থানা কিংবা কারাগার থেকে আদালতে আসামি স্থানান্তরের সময় পুলিশের হেফাজত থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি পত্রিকার পাতায়। কিন্তু তা আমাদের জন্য সাধারণত অতি বড় দুশ্চিন্তার হয় না। কেননা, এসব আসামি বেশির ভাগই তুলনামূলক কম ভয়ঙ্কর হয় তাদের অপরাধের বা দণ্ডের ভিত্তিতে। গত কয়েক মাসের কয়েকটি ঘটনা আমরা স্মরণ করিতে পারি। চলতি মাসেই জকিগঞ্জ থেকে সিলেট যাওয়ার পথে পুলিশের হাত থেকে ডাকাতি মামলার আসামি প্রস্রাব করার কথা বলে হ্যান্ডকাপসহ পালিয়ে যায়। এ বছর জানুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জ আদালতে জবানবন্দি দিতে এসে হত্যামামলার এজাহারভুক্ত এক আসামি হ্যান্ডকাপসহ পালিয়ে যায় । গত বছরের আগস্টে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া কোর্ট থেকে জেলহাজতে নেয়ার সময় চরখালী ফেরিঘাট থেকে এক আসামি হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থাতেই নদীতে ঝাঁপ দেয়। ধর্ষণ মামলায় চট্টগ্রামের আদালতে হাজিরার সময় গত বছরের সেপ্টেম্বরে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের তিন সদস্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায় এক আসামি। এরূপ ঘটনার শেষ নেই। সর্বশেষ গত রোববার আমরা দেখলাম, জামিন বাতিল হওয়ার আভাস পেয়ে হাজিরা দিতে এসে আদালত থেকে পালিয়ে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যামামলার চার আসামি।
অনেকেরই অভিমত রয়েছে যে, এ সকল ঘটনার কিছু কিছু ঘটে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যের যোগসাজশে। তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, তা তো সত্য, যতোটা নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে আসামি স্থানান্তরে, তা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই। মফস্বল এলাকায় প্রায়ই দেখা যায়, পুলিশ মোটরসাইকেলের পেছনে আসামি বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আদালত বা হাজতখানায়। এমন দৃশ্যও খুব সাধারণ যে, বড় প্রিজনভ্যানে বহুসংখ্যক আসামিকে নিয়ে যাওয়া হয় এক স্থান থেকে অন্যস্থানে; অথচ সে ভ্যানে পুলিশ সদস্য রয়েছে হাতেগোনা এক বা দুজন মাত্র। যেহেতু পুলিশের লোকবলের অভাব রয়েছে এবং এভাবে আসামি স্থানান্তরের সময় দুর্ঘটনার সংখ্যাও খুব বেশি নয়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের হয়তো বাড়তি মাথাব্যথা থাকে না।
কিন্তু আসামিরা যদি হয় সংঘবদ্ধ কোনো গোষ্ঠীর, কিংবা তাদের যদি থাকে বিশেষ ধরনের সংগঠিত শক্তি, তবে এ ধরনের আসামিদের স্থানান্তরের সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। পরিকল্পনা রাখতে হবে সম্ভাব্য সকল ধরনের বিপদের মোকাবেলা ও তা প্রতিহত করার। এতে কম লোকবলের অজুহাত চলে না। কেননা, আসামি পালায় বটে, কিন্তু সব ধরনের আসামির পালানোর ঘটনা বড় শিরোনাম হয় না, প্রশাসনেরও তীব্র মাথাব্যথার কারণ হয় না।