অবশ্য তিনি যখন অভিভাবক এবং সমাজ

একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার সন্তানকে মাদকমুক্ত রাখতে পারেননি বলে কোনো কর্তাই তা পারবেন না, এমনটি ভাবা কি ঠিক? অবশ্যই না। তবে মাদকের আগুন নেভাতে না পারলে সেই আগুনের ফুলকিতে নিজের সাজানো সংসারও তছনছ করতে পারে। এটা ভুললেই সর্বনাশ। সেই সর্বনাশা, সর্বগ্রাসী এখন আমাদেরই আশেপাশে। পরিস্থিতি ভয়াবহ থেকে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।

 

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, মাদক একদিনে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ায়নি। ধীরে ধীরে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। মাদকের ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা ঢাকা এসবির ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্ন খুনের মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাও আবার মেয়ে। মাদকাসক্ত মেয়ে তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে পুলিশ অফিসার পিতাকে খুন করেছে। একই সাথে খুন করেছে মাকে। এ ঘটনা নিশ্চয় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহের দায়িত্বশীল কর্তাদের কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। অবশ্য তাগিদ উপলব্ধি করার মতো বিবেকটাও তো আবার থাকতে হবে। দেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্তারা তো অর্থের নেশায় বুদ হয়ে থাকেন। দায়িত্ব পালনের নজির মেলে না। অভিযোগ রয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্তারা যেসব মাদক বিক্রেতার নিকট থেকে মাসোহারা পান না কেবলমাত্র তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেন। আর যেসব স্থানে মদ উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে সেখানে তো অর্থের বিনিময়ে দায়িত্বশীল অন্ধের মতো বসে থাকেন। তা না হলে মাদক অতো সহজলভ্য হয় কীভাবে? চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনায় মদের দোকান আছে। এ দোকানগুলোর একটিও কি বিধি মেনে চলে? মদপানের অনুমোদন প্রাপ্তদের জন্যই বরাদ্দ দেয়া হয় মদ, অনুমোদনপ্রাপ্তরা কি তাদের অনোমদনপত্র দেখিয়ে মদ কেনেন? দেখভালের দায়িত্ব যাদের তারা কোথায় থাকেন? এ মদ না হয় সমাজের নিম্নস্তরের কিছু মানুষ পান করে। ফেনসিডিল, মরফিন, কোকেন, হেরোইন ও ইয়াবা? উঠতী বয়সী থেকে শুরু করে এখন পেশাজীবীদের মধ্যেই ভয়াবহ আকারে ছড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের অনেকেই এসব নেশায় জড়িয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই পেশা হারিয়ে হচ্ছে পথের ভিখেরি। কেউ কেউ চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরাও পড়ছে। ফেনসিডিল, কোকেন, হেরোইন ও ইয়াবা কিন্তু দেশে তৈরি হয় না, প্রতিবেশী দেশ থেকে তা অবৈধ পথে পাচার করে আনা হয়। সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পাচার করে আনার সময় খুব কম চালানই বিজিবির হাতে ধরা পড়ে। সীমান্ত প্রহরায় অপ্রতুলতার অজুহাত যেমন আছে তেমনই আছে দায়িত্বশীলদের মধ্যে কারো কারো অর্থলিপ্সুতা। সামান্য অর্থের বিনিময়ে বস্তা বস্তা মাদক পাচারের সুযোগ করে দিলে তার খেসারত দেশবাসীকে দিতে হয়, হচ্ছে। পুলিশ? মাদক উচ্ছেদ করতে পারে, অবশ্য পারেও না। কেন পারে, কেন পারে না? কখন পারে কখন পারে না? পুলিশের কর্তারা যেমন জানেন, তেমনই সমাজের সচেতন মহলেরও আর অজানা নেই। একটি জেলায় পুলিশের কর্মকাণ্ড কেমন হবে তা কিন্তু পুলিশ সুপারের দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বলা অসম্ভব নয়। কেউ কেউ মুখে সাধু সাজেন, কিন্তু অর্থছাড়া তদবির বোঝে না। এরকম কর্তা হলে মাঠপর্যায়ের কর্তারা কোন পথে হাঁটবেন? কীভাবে সমাজে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে?

 

মাদকের কালোথাবা সর্বগ্রাসী রূপ তো আর একদিনে ধারণ করেনি। ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এরপরও হতাশ হলে চলবে না। সমাজ মাদকমুক্ত করার মতো অবস্থা এখনও রয়েছে। ম্যাক্সিকো তো আর হয়ে যায়নি! আভ্যন্তরে পুলিশ, ৱ্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়িত্বশীলদের সকলেই যদি মাদকের উগ্রতা উচ্ছেদে উঠে পড়ে লাগেন, অর্থের কাছে আপসের মানসিকতা পরিহার করেন আর সীমান্তরক্ষীরা যদি মাদকপাচার রুখতে সক্ষম হন তাহলে তো হাত বাড়ালেই কি মাদক মিলবে? উঠতী বয়সীদের মাদকমুক্ত করতে হলে মাদকের সহজলভ্যতা দূর করতে হবে। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে অবশ্যই সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। সেই আন্দোলন বেগবান করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সত্যি সত্যিই মাদক উচ্ছেদ অভিযানে সামিল হতে হবে। লোক দেখানো বা পিঠ বাঁচানো নয়, পুলিশ অফিসারদের নিজের সন্তানকে রক্ষা করার মতো করেই মাদকবিরোধী অভিযান নতুন করে শুরু করতে হবে। শুধু উপদেশমূলক সাইনবোর্ড রাস্তার ধারে ধারে ঝুলিয়ে রাখলে নিজের জীবনটা যে সন্তানের হাতেই বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি তা ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমানের নৃশংসতার শিকারের পর অস্বীকার করবেন কীভাবে? চুয়াডাঙ্গার রাস্তার ধারে কয়েকটি স্থানে লাগানো আছে পুলিশ সুপারের উপদেশবাণী। বলা আছে- ‘খেয়াল রাখুন- আপনার সন্তান কোথায় যায়? কাদের সাথে চলাফেরা করে? নিয়মিত স্কুল/কলেজে যায় কি-না? অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে থাকে কি-না? অস্বাভাবিক জীবনযাপন করে কি-না? আপনি যে অর্থ দেন তা সঠিকভাবে ব্যায় করে কি-না?

 

প্রশ্নগুলো শুধু সাধারণ অভিভাবকের ক্ষেত্রে নয়, একজন পুলিশ অফিসারের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়। অবশ্য তিনি যখন অভিভাবক। পুলিশ, ৱ্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বিজিবিসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দসহ সমাজের সচেতনবলে দাবিদার কেউই কিন্তু মাদক ঝুঁকিমুক্ত নই। অথচ সকলে নিজ নিজ অবস্থানে একটু দায়িত্বশীল হলেই সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভব।