স্টাফ রিপোর্টার: বর্তমান সংবিধানের আওতায় নির্বাচন না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিসভা বহাল থাকতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু কতোদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন সংবিধানে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। অন্যদিকে সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের কথাও সংবিধানে বলা আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জটিল এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংবিধান সংশোধনের বিকল্প নেই। তাদের মতে, সংবিধান সংশোধন না হলে দেশে চরম রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেবে। এমনকি গণতন্ত্রও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অপরদিকে জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় আর কোনো পরিবর্তন আনা হবে কি-না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সংবিধানে আর কোনো সংশোধনী আনবে না সরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে কি-না, তা সম্পূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। এদিকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের বিধান সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনো দেশে নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, ২৫ অক্টোবর বর্তমান সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমান জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। আদালতের নির্দেশনায় অবশ্য আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত ছিলো। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর অস্পষ্টতা দূর করতে সংসদের শেষ অধিবেশনে একটি বিল আনা হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেছিলেন। কিন্তু আইনমন্ত্রী জানান, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে পঞ্চদশ সংশোধনীর অস্পষ্টতা দূর করতে সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন হবে না।
সংবিধানের ৫৭ (৩) ধারা অনুযায়ী পরবর্তী সরকার দায়িত্বগ্রহণ না করা পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিলো। এ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমান সরকারও ওই পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে। তবে এ বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে হবে এবং ২৫ জানুয়ারির মধ্যে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
আইনমন্ত্রী জানান, সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদ এবং মন্ত্রিসভা বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে প্রেসিডেন্টকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে দেবেন এবং সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমান সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তাদের নিয়ে ছোট আকারের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে সরকার পরিচালনা করবেন। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় বর্তমান সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল থাকবে কি-না, তা সম্পূর্ণই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সংবিধানে আর কোনো সংশোধনী না আনার বিষয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, একজন সংসদ সদস্য থেকে নির্বাচন করবেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদ সদস্য না থাকা অবস্থায় নির্বাচন করবেন, এটি সকলের জন্য সমান সুযোগ, এ মৌলিক গণতান্ত্রিক বিধানের পরিপন্থি। এজন্যই আমরা সংসদ ভেঙে দিয়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, সংবিধানের ৫৬ (৪) ও ৫৭ (৩) অনুযায়ী অনির্বাচিত কারও অধীনে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে গেলে যদি নির্বাচন নাও হয় তাহলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালন করে যেতে কোনো বাধা নেই। তবে সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করার পরই কেবল রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেবেন। তখন রাষ্ট্রপতি ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করে নির্বাচন করতে বলবেন। অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, দেশে এখন সংঘাত অনিবার্য। আমরা মিসরের মতো পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এখন আর আলোচনা-সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। কারণ ইতোপূর্বে সমঝোতার ভিত্তিতে অনেক ছোটখাটো বিষয়েরই সমাধান হয়নি। তাতে করে জাতীয় নির্বাচনের মতো এতো বড় বিষয় আর এখন সমাধান করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, যখনই তড়িঘড়ি করে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিলো, তখনই স্পষ্ট হয়েছিলো দেশ সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধার কারণেই এটি করা হয়েছিলো। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ ব্যাপারে বলেন, আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেবেন। নইলে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে তাদের জন্য সেটা ‘শাঁখের করাত’ হয়ে দেখা দেবে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, একজন সংসদ সদস্য বহাল থাকলো, তাকে হয়তো নির্বাচনে মনোনয়ন দিলো না। তখন ওই সংসদ সদস্য তার এলাকায় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগবে। কীভাবে তাকে হারানো যায়, ওই সংসদ সদস্য সে চিন্তাই করবেন। নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালনের বিধান প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমার মনে হয়, সরকার এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেনি। অনেক সময় বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে ক্ষমতাবানরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেষ্টা করে। এ রকম কূটবুদ্ধির চাল চেলে যদি কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। সরকার যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবিধানের এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে সেটা অন্যায় হবে। সংবিধানের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হবে। দেশে গণতন্ত্র বলে কিছুই থাকবে না। কারণ গণতন্ত্রের মূল চেতনা হলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা। দেশ চরম সঙ্কটের দিকে চলে যাবে।
ড. মজুমদার আরও বলেন, নির্বাচন হতেই হবে। নির্বাচন না করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইলে সে সরকার অবৈধ হয়ে যাবে। কারণ সংবিধানে আছে এদেশ হবে গণতান্ত্রিক দেশ। অনির্দিষ্ট সময়ে জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ টিকে থাকতে পারে না। নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকতে হবে। আর বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে।
অন্যদিকে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি থাকলেও কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধীদল ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারেনি। দল দুটি তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে। সরকারি দল বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। শনিবারও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, এখন নির্বাচনের যে সময় আছে, তাতে প্রস্তুতি নেয়ার সময়। এখন কি কারণে বিরোধীদল আন্দোলনের নামে তাদের শক্তি ক্ষয় করবে। আর নির্বাচন হলে যে তাদের পক্ষে ফলাফল পায় না- একথা ঠিক নয়, সম্প্রতিককালের ফলাফলে তা প্রমাণিত হয়েছে। আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহম্মেদ বলেছেন, যখনই সরকার ছাড় দেবে, তখন আর সরকার থাকে না, সরকারের কর্মীদের অস্তিত্ব থাকে না। সুতারাং সংবিধান যেখানে আছে, সেখানে থেকেই নির্বাচন করতে হবে।
অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, সমঝোতার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিল পাস করতে হবে। নইলে দেশে চরম সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি হবে। সংঘাত অনিবার্য। আর এর দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। জাতীয় সংসদে ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী আইন-২০১১ পাস করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। সংশ্লিষ্টদের মতে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণেই আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এ চরম রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে গেলেও নির্বাচনের মাধ্যমে নবনির্বাচিতরা না আসা পর্যন্ত বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবে বলে বিধান রাখা হয়েছে। ফলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী কোনো কারণে নির্বাচন না হলে বর্তমান সরকার বহাল থাকলে কোনো সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি হবে না। তবে দেশে চরম রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেবে ও গণতন্ত্র বিপন্ন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংবিধানের এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে (ক) উপ-অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে-মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।’ ওই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে না। সংবিধানের ৭২ (১) অনুচ্ছেদে সংসদের অধিবেশন বসার ক্ষেত্রে ৬০ দিনের বেশি বিরতি থাকবে না বলে বলা হয়েছে। নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। তবে ওই সময়ে সংসদ সদস্যরা তাদের দায়িত্বে থাকবেন। এমনকি আগের সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন সংসদের নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, ওই উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’
এদিকে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮-এর ১৪ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘(১) সংসদের কোনো শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী কিংবা ওই মন্ত্রীদের পদমর্যাদাসম্পন্ন সরকারি সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন-পূর্ব সময়ের মধ্যে কোনো সফর বা নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে পারবে না; তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওই নির্বাচনী এলাকার ভোটার হলে তিনি কেবল ভোট প্রদানের জন্য ওই এলাকায় যেতে পারবেন।’
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংসদের কোনো আসনে উপনির্বাচনের সময় মন্ত্রী-এমপিরা যে কারণে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারেন না, একই কারণে জাতীয় নির্বাচনকালেও যেতে পারেন না। তাছাড়া বিধানটি করা হয়েছিলো সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো সংসদের মেয়াদ শেষে অথবা সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর। ফলে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কারোরই কোনো পদমর্যাদা ছিলো না। বর্তমানে সংসদ বহাল থাকলে এবং মন্ত্রী ও এমপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক হলে আইনি জটিলতা এবং সংবিধানের সমতার নীতি লংঘিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের কারণে কেউ কেউ ক্ষমতায় থেকে এবং কাউকে কাউকে ক্ষমতার বাইরে থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। যার মূল কারণ হচ্ছে, নির্বাচনকালীন মন্ত্রী-এমপিরা যাতে নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে প্রচারণা চালাতে পারে। তবে মূল সমস্যা হলো, ক্ষমতায় থাকাকালীন নির্বাচন করলে প্রধান বিরোধীদল সেটা মানবে কি-না তা নিয়ে। তবে বিরোধীদল নির্বাচনে না এলেও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে গেলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন। সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদ এবং ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদ একসাথে ব্যাখ্যা করলে এমনটিই দেখা যায়। তবে কতোদিন এভাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন তার কোনো ব্যাখ্যা সংবিধানের বিদ্যমান কাঠামোতে নেই।
আবার সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে’। এছাড়া সংবিধানের ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ অনুচ্ছেদ একসঙ্গে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা কোনোটাই গঠনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। সমঝোতার ভিত্তিতে হলেও নির্বাচনকালীন যে ধরনের সরকার ব্যবস্থা করা হোক না কেন তার প্রধান করতে হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে। ওই পদে অনির্বাচিত কাউকে বসানোর কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান সংবিধান যে রূপ নিয়েছে তাতে সংবিধান সংশোধন ছাড়া এসব পদ্ধতিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনেরও কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংবিধানের ৫৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।’ ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে তাহার সংখ্যার অন্যূন নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যগণের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন এবং অনধিক এক দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে মনোনীত হইতে পারিবেন।’ ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।’ ৫৬ অনুচ্ছেদের (৪) উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এ অনুচ্ছেদের (২) (প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত ) বা (৩) দফার অধীন (প্রধানমন্ত্রী) নিয়োগদানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাহারা সংসদ সদস্য ছিলেন, এই দফার উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তাহারা সদস্যরূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে যদি (ক) তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন; অথবা (খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন।’ আর ৫৭ অনুচ্ছেদের ৩)) এ বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না’।
সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদ একত্রে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা আছে যদি তারা পদত্যাগ না করেন তাহলে তাদের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদি কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন বা সংসদের আস্থা হারান তাহলেও নির্দলীয় কোনো ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৫৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোনো সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এইমর্মে সন্তুষ্ট হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেবেন।’
বর্তমান সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই আওয়ামী লীগের। ফলে প্রধানমন্ত্রী কোনো কারণে পদত্যাগ করলে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় আওয়ামী লীগ থেকে আরেকজন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবেন। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। ওই সরকারের দশ ভাগের একভাগ সদস্য অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। কিন্তু সংসদ সদস্য নন এমন কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নেই।