স্টাফ রিপোর্টার: রায় ঘোষণার আগে বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আসামিদের ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দশ ট্রাক অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফার জন্য আনা হয়েছিলো। দেশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে উলফা, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং পাকিস্তানের আগা রহমান ইউসুফ গ্রুপের (এআরওয়াই গ্রুপ) যোগাযোগ ছিলো- সেটাও সাক্ষ্যপ্রমাণে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক শিল্পমন্ত্রী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া একই ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনের দায়েরকৃত অপর মামলায় এ ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১’র বিচারক এসএম মুজিবুর রহমান। দুপুর ১২টা ২৭ মিনিটে রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া শুরু করেন তিনি। প্রথমে অস্ত্র মামলা এবং পরে চোরাচালান মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। চোরাচালান মামলায় মোট ৫২ আসামির মধ্যে ৩৮ জন বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অস্ত্র মামলায় আটক মোট ৫০ আসামির মধ্যে ৩৬ জন বেকসুর খালাস পান। খালাসপ্রাপ্তরা সবাই মূলত সিইউএফএল জেটি ঘাটের শ্রমিক ও মাঝিমাল্লা।
ওরা ১৪ জন: মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১১ জন হচ্ছেন- সাবেক শিল্পমন্ত্রী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) উইং কমান্ডার (অব.) সাহাবুদ্দিন আহমদ, এনএসআইয়ের সাবেক উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের সাবেক ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সারকারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কেএম এনামুল হক, সাবেক অতিরিক্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান, অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ ও ট্রলারমালিক হাজি আবদুস সোবহান।
চোরাচালান মামলায় এই ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড এবং অস্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি বিস্ফোরক আইনে আরও সাত বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন বিচারক। রায় ঘোষণার সময় বাবর-নিজামীসহ ১২ আসামি আদালতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার পর থেকে পলাতক দু আসামি নুরুল আমিন ও পরেশ বড়ুয়া হাজির ছিলেন না।
আদালতের চিত্র: দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ঘোষণা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরসহ আশপাশের এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলা হয়। বেলা সোয়া ১১টায় চট্টগ্রাম কারাগার থেকে ১১ আসামিকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ছাড়া আর সবাইকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। আসামিদের সবাইকে সংশ্লিষ্ট আদালত কক্ষে নেয়া হয়। ৯ আসামিকে ডকের ভেতর ঢোকানো হলেও বাবর-নিজামী ডকে ঢুকতে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় পুলিশের সাথে তাদের মৃদু বাকবিতণ্ডা হয়। ডকে না ঢুকে তারা দুজনই বসে পড়েন পেছনের সারির বেঞ্চে। এ সময় দুজনকেই বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে দেখা যায়। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১’র বিচারক এসএম মুজিবুর রহমান এজলাসে প্রবেশ করেন। এর আগেই বাবর-নিজামীকে অন্য আসামিদের সাথে ডকে ঢোকানো হয়। বিচারক প্রথমেই জামিনে থাকা আসামি হাজি আবদুস সোবহান উপস্থিত আছেন কি-না জানতে চান। সোবহান হাত উঁচিয়ে উপস্থিতি জানান দিলে তাকে ডকে ঢোকানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
পর্যবেক্ষণের পরই বিচারক রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান। মাত্র ২২ মিনিটের মধ্যে পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন এবং রায় ঘোষণা শেষ করে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন। রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের বিপুল সংখ্যক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। জনাকীর্ণ আদালতে বিচারকের কণ্ঠ শুনতে না পেয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অনেকে চিৎকার করে কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। রায়ের পর আদালতে হাজির ১২ আসামির সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।