মহাসিন আলী: মায়ের চিকিৎসার ভার ৫ ছেলে না নিলেও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৭৫ বছর বয়সেও খড়ের বাড়ুন পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধ সলেমান মণ্ডল। এরপরও স্বামীর ভাত বঞ্চিত মেয়ে ও তার ২ সন্তান চেপে বসেছে বৃদ্ধের ঘাড়ে। বৃদ্ধ সলেমান বাস করেন মেহেরপুর জেলা শহরের দীঘিরপাড়া গ্রামের বেলেগাড়িপাড়ায়।
মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের দীঘিরপাড়া গ্রামের বেলেগাড়িপাড়ার মৃত আহমেদ আলী মণ্ডলের ছেলে সলেমান মণ্ডল। পেশায় তিনি ছিলেন একজন কৃষক। তার নিজের জমি ছিলো না। তাই অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করতেন। সংসার জীবনে তার রয়েছে স্ত্রী এবং ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ে। তার স্ত্রী রিজিয়া খাতুন (৬৫) পঙ্গু। তার ওপর চেপে বসেছে স্বামীর ভাত বঞ্চিত এক মেয়ে। মেয়ের সাথে আছে তার দু ছেলে-মেয়ে। কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা সলেমানের বর্তমানে কঠোর পরিশ্রম শরীরে সহ্য হয় না। তাই তিনি চাষবাস ছেড়ে দিয়েছেন। যে বুড়ো বয়সে বসে বসে তার ৫ ছেলের ভাত খাওয়ার কথা। আর নাতি-পুতিদের নিয়ে আনন্দ করার কথা। সেই বয়সে সুখ তার কপালে জোটেনি। নিজের জন্য নয়, অসুস্থ স্ত্রী রিজিয়া খাতুনের চিকিৎসার জন্য গত ৫ বছর ধরে ভ্যানে করে নিজের হাতে তৈরি খড়ের বাড়ুন নিয়ে শহর ও গ্রামের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধ সলেমান মণ্ডল। প্রতিটি বাড়ুনে তার লাভ আসে দেড় টাকা থেকে ২ টাকা।
চাপা ক্ষোভ আর এক বুক দুঃখ নিয়ে সলেমান মণ্ডল বললেন, কপালে সুখ তার ধরা দেয়নি। বয়সকালে ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ে মানুষ করতে অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করেছি। তাদের বড় করেছি। মনে হয়েছিলো ছেলেরা বড় হলে শেষ বয়সে বসে থেকে আমরা বুড়ো-বুড়ি দু বেলা দু মুঠো ভাত খাবো। সে সুখ কপালে সইলোনা তাদের। স্ত্রী রিজিয়া খাতুন অসুস্থ। ১০ বছর ধরে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে। ছেলেরা তাদের মাকে চিকিৎসা করে না। খেতে দেয় না। যাকে জীবনসঙ্গী করে ঘরে নিয়ে এসেছি। তাকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না। ছেলেরা তাদের মাকে না দেখলে কি হবে? আমি তো আর তাকে ফেলে দিতে পারি না। এরপরও এক জামাই তার দু সন্তানসহ আমার মেয়েকে আমার ঘাড়ে ফেলে গেছে। সে আর ফিরে আসে না। তাদের খোঁজ-খবরও রাখে না। এ বৃদ্ধ বয়সে শীরর চলে না। তারপরও সকলের মুখে দিকে চেয়ে আমি এ কাজটি বেছে নিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবারে তিনি আরো বলেন, গ্রামের মেম্বার বয়স্কভাতার একখানা কার্ড করে দিয়েছে। প্রতি ৩ মাস অন্তর একবার ইউনিয়ন পরিষদ গিয়ে ৯শ টাকা করে পাই। তার স্ত্রী পায় না বয়স্কভাতা। অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ কেনাসহ ৫ জনের সংসার চালানো খুবই কষ্টের। তাই গ্রাম থেকে খড় কিনে রোদে শুকিয়ে এবং দড়ি ও কাঠি কিনে নিজের হাতে বাড়ুন বানাই। অনেক কষ্টে কেনা ভ্যান চালিয়ে এক দিন বাদে একদিন শহর ও জেলার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের পাড়া মহল্লায় গিয়ে বাড়ুন বিক্রি করি। প্রতিদিন দেড়শ থেকে ২শ বাড়ুন বিক্রি হয়। তাতে যে লাভ আসে তাতে কোনোভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন চালাতে হয়। সবশেষে তিনি আক্ষেপ করে বললেন- তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যদি কোনো সরকারি-বেসরকারি কিংবা দাতা সংস্থা এগিয়ে আসতো তবে তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেন।