স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধান আরপিও’র ৯১ই ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন বৈঠকে এ ধারাটি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে আগামী নির্বাচনে এ ধারা প্রয়োগ করতে পারবেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। এর আগে অপ্রয়োগযোগ্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ দাবি করে ৯১ই ধারাটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে এক মাস পর্যালোচনার পর প্রার্থিতা বাতিলের বিধান বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিলো কমিশন। এ ধারাটি সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে না বলে জানিয়েছে ইসি।
৯১ই ধারা বহাল রাখার বিষয়ে কমিশনের অবস্থান তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ গতকাল বৃহস্পতিবার কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ৯১ই ধারা বাতিলে কমিশনের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। এসব মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৯১ই ধারা বাতিলের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অর্থাৎ আগের মতোই ৯১ই ধারা বহাল থাকছে। এতে কোনো সংশোধনী আনা হচ্ছে না।
এর আগে সিইসি ৯১ই ধারাকে অপ্রয়োগযোগ্য দাবি করে তা বাতিল করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান। ৯১ই ধারাটি বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে গত মঙ্গলবার ইসি সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর দু দিনের মধ্যে সেই অবস্থান থেকে সরে আসার কথা জানাল নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শাহ নেওয়াজ বলেন, ৯১এ ধারায় প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেয়া আছে। ৯১ই ধারাটি একই আইনের ১৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই ৯১ই ধারাটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন মহলের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৯১ই ধারাটি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন আগের মতামত থেকে সরে আসেনি। আগের দেয়া ব্যাখ্যায় এখনও আমরা অটল আছি। এ ধারাটির সঙ্গে ১৯ ধারার অসামঞ্জস্য রয়েছে। প্রয়োগে কিছু অসুবিধা আছে। তবুও বিভিন্ন মহলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা বহাল রাখা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। ফোনে তিনি এ বিষয়ে তার মতামত দিয়েছেন। এখন আরপিও সংশোধনের বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছেও বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে কমিশন সচিবালয় থেকে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। কমিশনের পরিচালক (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) এর ৯১ই বিধানে অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধিতা এবং ১৯ বিধানের সঙ্গে পরস্পর বিরোধিতা থাকায় এবং ১৯ বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে ৯১ই আংশিক সংশোধনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করেছিল। কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যম ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিলে ৯১ই বাদ দেয়ার জন্য কমিশন একটি প্রস্তাব তৈরি করে। তা আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের আগেই গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে প্রতিক্রিয়া দারুণভাবে প্রতিকূল। কমিশন সে প্রতিক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ৯১ই এর কোনো সংশোধনী প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করছে না।
সূত্র জানায়, ৯১ই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণ বিধি লংঘনের গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা থাকার অযোগ্য হতে পারেন। তবে তার আগে কমিশন অভিযুক্ত প্রার্থীকে শুনানির যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দিয়ে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেবে। তদন্তে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে কমিশন সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাকি প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রার্থী বাতিলের পর যদি একজন প্রার্থী অবশিষ্ট থাকেন, তাহলে সেই আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পুনরায় তফসিল ঘোষণা করা হবে।
কমিশন কর্মকর্তারা জানান, প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা সংক্রান্ত ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। তবে কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হলে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একজন হলে তাকে বিজয়ী ঘোষণার বিধান যুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় আপত্তি জানিয়েছে। অপরদিকে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা লোপের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র আপত্তি উত্থাপিত হয়।
৯১ই ধারা বাতিলে যে যুক্তি দেখিয়েছিলো ইসি: ৯১ই ধারা বাতিলের পক্ষে সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট একটি ব্যাখ্যা দেয় কমিশন। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়, ২০০৮ সালের আগে এই অনুচ্ছেদ আরপিওতে ছিলো না। ২০০৮-এর ৪২নং অধ্যাদেশমূলে এই অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করা হয়। দেখা যায় যে, ৯১ই ধারাটি ১৯-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনুচ্ছেদ ১৯-এর বিধান এই যে, বাছাইকালে কোনো মনোনয়নপত্র বাতিলের ফলে অবশিষ্ট প্রার্থী একজন থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা করতে হয়। কমিশনের ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের বিধান রয়েছে। কিন্তু ৯১ই-এর বিধান তার বিপরীত। ৯১ই মোতাবেক অসদাচরণকারী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে অবশিষ্ট একজন প্রার্থীর ক্ষেত্রে নির্বাচনী কার্যক্রম বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণা করার অর্থ দাঁড়ায় যে অবশিষ্ট একক প্রার্থী নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রার্থিতা বাতিল করা। এভাবে অপরাধীর দোষের কারণে নির্দোষকে শাস্তি দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। অসদাচরণের দায়ে কোন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হলে অবশিষ্ট প্রার্থী দুই বা ততোধিক থাকলে তখন সেই সীমিত সংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ৯১ই-তে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন তফসিল নয় এবং নতুন কেউ প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবে না। এতে দেখা যায় যে, ৯১ই অনুচ্ছেদ মোতাবেক অসদাচরণের জন্য কোন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পর অবশিষ্ট প্রার্থীর সংখ্যা এক ও একাধিক হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রায়োগিক দিক বিবেচনায় দেখা যায়, অনুচ্ছেদ ৯১ই আদৌ প্রয়োগযোগ্য নয় এবং অর্থহীন। এসব দিক বিবেচনা করে বর্তমান কমিশন অনুচ্ছেদ ১৯-এর অনুরূপ অবশিষ্ট প্রার্থী একজন হলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করার বিধান করে অনুচ্ছেদ ৯১ই সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। নির্বাচন কমিশন প্রার্থী বাতিল করার ক্ষমতা রাখতে চায়। ৯১ই বাতিল করা সত্ত্বেও এই ক্ষমতা কমিশনের কাছে থাকবে। কেননা প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা বর্তমান আরপিওতেই ৯১এ অনুচ্ছেদে সংরক্ষিত রয়েছে।