স্টাফ রিপোর্টার: সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন বিদেশি প্রভাবশালী কূটনীতিক ও বিভিন্ন উন্নয়ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। গতকাল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ তাগিদের পাশাপাশি নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দিয়েছেন তারা। এছাড়া নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কর্মকর্তার নিরপেক্ষতা, প্রার্থিতা বাতিল সংক্রান্ত আরপিও’র ৯১ই ধারা, বিতর্কিত রাজনৈতিক দল বিএনএফ’র নিবন্ধন, সেনাবাহিনী মোতায়েনে ইসির অবস্থান, নির্বাচনকালীন আচরণ বিধি এবং সর্বোপরি বর্তমান কমিশনের ভাবমূর্তি নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থার নানামুখী প্রশ্নের মুখে পড়েছিলো কমিশন। বৈঠকে উপস্থিত সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সাড়ে ছয় লাখ নির্বাচন কর্মকর্তার (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং ও সহকারী পোলিং অফিসার) নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা চেয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক নিল ওয়াকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাব করেছেন। আর যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নিক লো নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকছে কি-না তা জানতে চেয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে তাদের আশ্বস্ত করেছেন। তিনি তাদের বলেছেন, বর্তমান কমিশন যেকোনো মূল্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জাতিসংঘ প্রতিনিধি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাপান, নরওয়ে, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউএনডিপি, ইউএসএআইডি, ডিএফআইডির প্রতিনিধি বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকের শুরুতে আমন্ত্রিত অতিথি ও কমিশনের মধ্যকার পরিচয় পর্বের পর টানা প্রায় বিশ মিনিট উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন সিইসি। লিখিত বক্তব্যের একটি কপিও দেয়া হয় কূটনীতিক ও দাতাদের। সিইসির ওই বক্তব্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেসব অনুষঙ্গ অপরিহার্য ওই বিষয়গুলোতে কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা পয়েন্ট আউট করে কমিশনের অবস্থান জানতে চান। বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা কমিশনের কাছে জানতে চান নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত প্রায় সাড়ে ছয় লাখ নির্বাচন কর্মকর্তা নিরপেক্ষ থাকবেন তার নিশ্চিয়তা কি? জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, সারাদেশে একসাথে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনের বিপুলসংখ্যক জনবলের প্রয়োজন পড়ে। এসব ক্ষেত্রে কমিশন সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজ করে আসছে। নির্বাচনের আগে তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মতামতা নেয়া হয়। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দলীয় অভিযোগ থাকলে কমিশন যাচাই-বাছাই করে তাদের বাদ দেয়।
এ সময় তিনি গাজীপুর নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে ৫/৬ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন বলে কূটনীতিকদের অবহিত করেন। এছাড়াও নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্বাচনী কাজে অবহেলা কিংবা নিয়মবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলে শাস্তির বিধান আছে বলে তাদের সিইসি জানান।
ড্যান মজীনা সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের বসার বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে কমিশনের কাছে জানতে চান আপনার এতো পরে (নভেম্বর) দলগুলোর সাথে সংলাপে বসার উদ্যোগ কেন নিতে যাচ্ছেন। জবাবে সিইসি বলেন, আমরা এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসার কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে বিগত কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসেছিলো। আমরা সীমানা পুনঃবিন্যাস ইস্যুতে তাদের সাথে বসেছিলাম। তবে সংসদ নির্বাচনের আগে প্রয়োজন হলে কমিশন তাদের সাথে সংলাপে বসবে।
বৈঠকে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক নিল ওয়াকার নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে সিইসি বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। এর আগে কমিশনের পক্ষ থেকে অনুমতি বা আমন্ত্রণের কোন সুযোগ নেই। তবে কেউ নিজ উদ্যোগে পর্যবেক্ষণে এলে কমিশন তাদের অসহযোগিতা করবে না। তবে সিইসির এমন জবাবে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে ইসির অবস্থান জানতে চান যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার নিক-লোসহ অন্য কূটনীতিকরা। জবাবে সিইসি বলেন, ২০০১ সালের আগে সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত কোনো বিধান আরপিওতে ছিলো না। ১৯৭৩ সাল থেকে সব সাধারণ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বেসামরিক শক্তির সহায়তার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জেলা/থানা/উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে; কিন্তু ২০০৯ সলের ১৩ নং আইনে তা বাদ দেয়া হয়। ৯টি সাধারণ নির্বাচনে কোন না কোন উপায়ে সেনাবাহিনী নির্বাচনী কাজে কমিশনকে সহায়তা করেছে। আসন্ন নির্বাচনেও সেনাবাহিনী কমিশনকে সহায়তা করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বৈঠকে নির্বাচনী আইন লংঘনের কারণে প্রার্থিতা বাতিল সংক্রান্ত ইসির দেয়া আরপিওর ৯১ই ধারা সংশোধনের প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চান যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার। জবাবে সিইসি বলেন, এই ধারাটি বাতিলের পরেও ইসির কাছে একই ধরনের ক্ষমতা থাকবে। সংশ্লিষ্ট ধারাটি প্রয়োগযোগ্য নয় এবং এটি আরপিওতে সন্নিবেশ করার পরে কখনই ব্যবহার করা যায়নি। আরপিওর অন্য একটি ধারার সাথে এটি সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নিবন্ধনের জন্য বিতর্কিত রাজনৈতিক দল বিএনএফ’র নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়েও কমিশনের অবস্থান জানাতে চান। সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ। এক্ষেত্রে কমিশন নিবন্ধন দেয়ার আগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কারো কোন আপত্তি আছে কি-না তা জানতে চায়। তাই শর্ত পূরণ না করলে কোন দলের নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ নেই।
বৈঠক সূত্র আরো জানায়, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার বিষয়টিও তাগিদ দেন কূটনীতিক ও দাতারা। জবাবে সিইসি বলেন, সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (ক) ও (খ) অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সময় সরকারি প্রটোকল পাবেন না, তবে প্রটেকশন পাবেন। এজন্য নির্বাচনী আচরণবিধি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এখনো আরপিও চূড়ান্ত না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানান সিইসি।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির সংলাপ ও ইসির ভাবমূর্তি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও জনমনে বিভ্রান্তি দূর করতে কমিশনের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চান দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। কমিশনের পক্ষ থেকে তিনশ সংসদীয় আসনের ভোট কেন্দ্রগুলো ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের সহায়তা চাওয়া হয়। পাশপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আরো বেশি অর্থ চান সিইসি।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক যা বলেন: বৈঠক শেষে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক নিল ওয়াকার জানান, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে তারা নির্বাচন কমিশনে এসেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনই তাদের পারস্পরিক প্রত্যাশা। সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা নিয়ে তারা কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনকে সব দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলুক। আমাদের প্রত্যাশা- নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এর জন্য সবধরনের কারিগরি সহায়তা দিতে আমরা কমিশনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সাংবাদিকদের সিইসি: বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালির কলম ও কিছু ভিডিও ক্যামেরাসহ কারিগরি ও নির্বাচনী উপকরণ নিয়ে দাতা দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে থাকে ইসি। সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এসব বিষয় নিয়েই বৈঠকে কথা হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে দাতাদের অবস্থান জানতে চাইলে সিইসি বলেন, আমাদের লক্ষ্য সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তা আয়োজনে আমরা বদ্ধপরিকর। দাতা দেশগুলোও সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। আমরা তাদের সাথে একমত। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে ইসির সার্বিক প্রস্তুতির কথা দাতা দেশগুলোর কাছে তুলে ধরা হয়েছে বলে সিইসি জানান। নির্বাচনে কেন্দ্রগুলোতে ভিডিও করার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। আমরা এ সহায়তা চাইলাম। তারা বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইসি কোনো সংলাপ করবে কি-না, এমন প্রশ্ন করা হলে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আগের কমিশন কয়েকটা সংলাপ করেছে। আমরাও সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করেছি। এছাড়া আমরা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি, ফরমালি বসা ছাড়াও আমাদের সাথে ইমেল, সরাসরি ও টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারেন। যেকোনো বিষয় নিয়ে যেকোনো দল আমাদের সাথে বসতে পারেন।