স্টাফ রিপোর্টার: দেশের প্রায় ১৪ হাজার বস্তির ২৪ লাখ বাসিন্দা করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে কোনো একটি বস্তির কেউ আক্রান্ত হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। এসব স্থানে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে অনেক মানুষের বাস। এদের পক্ষে নিজ বাসায় কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন সম্ভব নয়। শরীরে করোনাভাইরাস আছে কি না তা শনাক্ত করাও কষ্টসাধ্য। ফলে এদের জন্য সরকার বা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে আলাদা করে ভাবতে হবে। অন্যথায় বস্তিবাসীর মাধ্যমে অল্পসময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরকারি চিকিৎসা সহযোগিতার আওতায় আনতে সহযোগিতার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী রূপ ধারণ করেছে। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশ। একেক শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য আলাদা আলাদা করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়ার সক্ষমতা সরকারের নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। এমন কিছু বলতে চাই না, যেটার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’
খোঁজখবরে জানা যায়, ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে ওঠা বস্তির ঘরগুলোতে পানির তীব্র সংকট। পাশাপাশি অল্প জায়গাতেই গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয় প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের। যেখানে একজন ব্যক্তিও ভালোভাবে থাকতে পারে না সেখানে থাকেন একাধিক মানুষ। রান্না, কাপড় ধোয়া, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষা ও অবসর সবকিছুই এখানে একটি সাধারণ জায়গায় সম্পন্ন হয়। সেখানে কেউ মাস্ক ব্যবহার করে না। যারা দিনরাত পরিশ্রম করে দু’মুখো অন্নের সংস্থান করতে পারে না, সেখানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের চিন্তা করা যায় না। এসব কারণে নভেল করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য বস্তি একটি আদর্শ পরিবেশ বটে।
আরও জানা যায়, বস্তির বেশির ভাগ মানুষ রিকশা বা ভ্যান চালিয়ে জীবন ধারণ করে। এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসা, গার্মেন্ট কর্মী, মজুর, কুলি, শ্রমিক এবং বাসা বা অফিসের রান্না এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পেশাগত কাজের প্রয়োজনে এসব বস্তির বাসিন্দারা সমাজের অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মিশে থাকে। সে কারণে বস্তিবাসীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউিট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বস্তিবাসীর জন্য সরকার সচেতনতামূলক কার্যক্রমে বেশি জোর দিতে পারে। এছাড়া তাদের জন্য এই মুহূর্তে তেমন কিছু করার নেই। তবে এটা সত্য যে, তারা খুবই বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বস্তিবাসীরা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এই মুহূর্তে সরকার তাদের জন্য তেমন কিছু করতেও পারবে না। তবে সরকার যদি তাদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করতে পারে, সেটা তাদের উপকারে আসবে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোক গণনা-২০১৪ অনুযায়ী, দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১ হাজার ৬৩৯টি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১ হাজার ৭৫৫টি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বস্তির সংখ্যা রয়েছে ২ হাজার ২১৬টি, খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১ হাজার ১৩৪টি, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১০৪টি, পৌরসভা এলাকায় ৩ হাজার ৩৫৭টি (এই জরিপের পর কয়েকটি পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়েছে) এবং অন্যান্য শহর এলাকায় ১ হাজার ৪৬৫টি।
আর এসব বস্তির খানার (পরিবার) সংখ্যা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি, পৌরসভা এলাকায় ১ লাখ ৩০ হাজার ১৪৫টি এবং অন্যান্য এলাকায় ৩২ হাজার ৯৬০টি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ‘ডিএসসিসির বস্তি উন্নয়ন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে বস্তিবাসীদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসা সহযোগিতা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা তাজিনা সারোয়ার বলেন, ‘সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনার আলোকে শহরের বস্তিবাসীদের করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন সহযোগিতা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলরদের মাধ্যমে এসব সমন্বয় করে করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিগগিরই কাউন্সিলরদের নিয়ে সভা করা হবে। বস্তিবাসীদের জন্য আরও কী কী করা যায়, সেসব ব্যাপারেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’