করোনাভাইরাসের প্রভাবে মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে

স্টাফ রিপোর্টার: চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশে সড়ক, রেল, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতের অবকাঠামো উন্নয়নের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি থেমে যেতে পারে। কারণ প্রকল্পগুলোর বড় একটি অংশই বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায়। এসব প্রকল্পে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও কর্মীরা কাজ করছেন। তাঁদের অনেকেই এখন চৈনিক নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য ছুটিতে দেশে রয়েছেন। চীনের পরিস্থিতি বিবেচনায় তাঁদের ফিরতে এবং কাজে যোগ দিতে দেরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বিভিন্ন প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ছুটি নিয়ে চীনে যাওয়া কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে ফেরা বিলম্বিত হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কর্মরত চীনের শতাধিক কর্মকর্তা এরই মধ্যে তাঁদের ছুটি আরো বাড়ানোর আবেদন করেছেন। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের নাগরিকরা কর্মরত। এসব প্রকল্পে চীনের কমপক্ষে দেড় হাজার নাগরিক কাজ করছেন। চৈনিক নববর্ষ ছিল গত ২৫ জানুয়ারি। এটি সে দেশে অন্যতম বড় উৎসব। এই উৎসব পালনের জন্য গত সপ্তাহ ও তারও আগে ছুটিতে চীনে গিয়ে আটকে পড়েছে তাদের বড় একটি অংশ। আবার অনেকে ফিরে এলেও তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প এলাকায়। সম্প্রতি চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৩২-এ দাঁড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ছয় হাজার। চীন ছাড়াও এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, জার্মানি, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। গত ৯ দিনে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনফেরত তিন হাজারের বেশি ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো করোনোভাইরাসে আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর ১০টি অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণ করছে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কম্পানি। নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দেশের সবচেয়ে বড় এ সেতুর তিন হাজার ৩০০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২২টি স্প্যান বসানো হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে চীনের এক হাজার ১০০ জন নাগরিক কাজ করছেন। এর মধ্যে ছুটিতে চীনে গিয়েছিলেন ২৫০ জন। ২২ জানুয়ারি ছুটিতে গিয়ে তাঁদের বড় অংশ ফিরতে পারেনি। এখনো শতাধিক আটকে আছেন চীন সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে। এরই মধ্যে ছুটি কাটিয়ে ৩৫ জন চীনা কর্মকর্তা কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মাঠপর্যায়ের কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। প্রকল্পের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে চীন থেকে সদ্য ফিরে আসা এই কর্মকর্তাদের। সেখানে তাঁদের ১৪ দিনের পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। তাঁদের এ সময় কেবল দাপ্তরিক কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীন পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজও এগোচ্ছে। এ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ চীনের কয়েকজন কর্মকর্তাও এখন ছুটিতে দেশে অবস্থান করছেন। জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে প্রায় আড়াই শ চীনা ব্যক্তি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা আসতে শুরু করেছেন। তবে তাঁদের বড় অংশই চীনে অবস্থান করছে। যাঁরা চীন থেকে ফিরেছেন ১৪ দিন পর্যবেক্ষণ শেষ না হলে মাঠপর্যায়ে তাঁদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা তাঁদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনসহ সবাইকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।’ করোনাভাইরাস পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে প্রভাব ফেলবে না বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল নিজ মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘চীন থেকে যাঁরা আসছেন তাঁদের ব্যাপারে আমাদের নজরদারি আছে। আমরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। যাঁরা এরই মধ্যে এসেছেন নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের ১৪ দিন কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখা হয়েছে। এতে আমাদের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই বিঘ্নিত হবে না।’

ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত চীনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। আগামী মাসে তাঁদের ফেরার কথা। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাঁরা ফিরতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে গতকাল দুপুরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘সওজ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের কর্মকর্তারা যুক্ত আছেন। অনেকে ছুটিতে গেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁদের অনুপস্থিতির জন্য প্রকল্পের কাজ বিঘ্নিত হয়নি। তবে আমরা আশা করছি দ্রুত এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।’

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের অগ্রগতি ৫১ শতাংশ। এ প্রকল্পে যুক্ত চীনের এক শ নাগরিক ছুটিতে গেছেন। আর না ফেরায় কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাঁদের চীন সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে অনুরোধ করেছি। প্রকল্প ব্যবস্থাপক একজনও চীনে গিয়ে ফিরতে পারছেন না। তবে কাজের গতি যাতে বিঘ্নিত না হয় সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আর এ নিয়ে ভাবতে হবে না।’ এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ প্রকল্পে যুক্ত চীনের অর্ধশতাধিক নাগরিক। তাঁদের বেশির ভাগই ছুটিতে দেশে গিয়ে আর আসতে পারছেন না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।