ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে গালফ নিউজকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য কী তা বোঝা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে গালফ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। ব্যস্ত কর্মসূচিরই ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী গালফ নিউজকে ওই সাক্ষাৎকার দেন। এটি তাদের অনলাইনে প্রকাশ হয় ১৮ জানুয়ারি। শেখ হাসিনা বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য কী, তা বুঝতে পারছি না। কেনো ভারত সরকার এটা করলো। এটা প্রয়োজন ছিলো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভারতে পাড়ি দেয়া কেউ বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এমন নজির নেই। তবে ভারতে অনেকে সমস্যার মধ্যে আছে। বাংলাদেশ সবসময়ই এই সিএএ ও এনআরসিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই মনে করে আসছে। ভারত সরকারও সবসময় বলে আসছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ব্যক্তিগতভাবে গত অক্টোবর মাসে নয়াদিল্লি সফরকালে আমাকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। প্রতিবেশী হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী। এ বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে নিপীড়নের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে আইন সংশোধন করেছে ভারত। বিতর্কিত এ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দেশজুড়ে সরব হয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দল। চলছে দফায় দফায় বিক্ষোভ। আইনটি বাতিলের দাবিতে ভারতজুড়ে এখনও বিক্ষোভ চলমান। এতে বেকায়কায় রয়েছে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা মনে করছেন ভারতে থাকা মুসলিমরা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজবে। বাংলাদেশে এক কোটি ৬০ লাখ হিন্দু (মোট জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ) থাকার তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশিদের ভারতে পাড়ি দেয়ার বিষয়টি নাকচ করেন।
রোহিঙ্গা সংকট : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের শুরু মিয়ানমারে। তাদের কাছেই এর সমাধান রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এখন পর্যন্ত দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে চায়নি। ফলে আমাদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার আসলে প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর বোঝা বহন করতে পারবে না। এ সমস্যা থাকলে আমাদের দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই সংকট সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।
কার্বন নিঃসরণ: কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনায় পরিবেশবাদীদের শঙ্কা প্রকাশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন। তিনি বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশের ক্ষতি করবে না। বাংলাদেশ এখন আড়াই শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদন করে। আমরা এটা ২৫ শতাংশে উন্নীত করবো। শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব বেশি কার্বন নিঃসরণ করে না। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছুটা কার্বন ব্যবহার করতে পারা উচিত বাংলাদেশের। উন্নয়ন রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে এটা জরুরি।
নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র: ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ২৯টি কয়লা খনি তৈরির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে থাকা চার কোটিরও বেশি মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর ভাঙনেরও ঝুঁকি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের প্রথম কয়লা খনি তৈরির ২২ বছর হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো পরিবেশের ক্ষতি দেখিনি আমরা। আমি ব্যক্তিগতভাবে দিনাজপুরে গিয়ে সেই কেন্দ্র সফর করে এসেছি।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা সামাল দিতে এমন করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘৯৫ শতাংশ জনগণ এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু মানুষ বাড়ছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। ফলে চাহিদাও বাড়ছে। মোবাইল, কম্পিউটার থেকে শুরু করে ডিজিটাল ক্লাসরুমে এখন বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন।’
প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাব : অতীতে বাংলাদেশ বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করত প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক দশক আগেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উৎস ছিলো গ্যাস। কিন্তু আমাদের গ্যাস কমে যাচ্ছে। তাই কয়লা, তরল জ্বালানি ও পরমাণু শক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের। শেখ হাসিনা বলেন, ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। নেপাল, ভারত ও ভুটানের সঙ্গে জলবিদ্যুতের চুক্তি করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশে ২ দশমিক ৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। দেশজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে ৫৩ লাখ সোলার প্যানেল। এছাড়া ছাই বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ: বাংলাদেশ বারবার প্লাস্টিক নিষিদ্ধের কথা বলে আসছে। ২০০২ সালে একবার পলিথিন নিষিদ্ধ করাও হয়েছিলো। এখনও উপকূলীয় অঞ্চলে হোটেল, রেস্টুরেন্টগুলোতে প্লাস্টিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখনও শতভাগ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে সফল হয়নি। মূলত কম টাকায় বিকল্প তৈরি করা যায়নি এখনও। তবে পরিস্থিতি পাল্টেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আমাদের কাছে বিকল্প আছে। এখন ভুট্টা নিয়ে বায়োগ্রেডেবল ব্যাগ তৈরি করেছি আমরা। এছাড়া পাট দিয়েও ব্যাগ তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা। আমি এর নাম দিয়েছি সোনালি ব্যাগ। আমাদের পাট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন এটা কম দামে বাজারজাত করা হয়।