না ফেরার দেশে চলে গেলেন মেহেরপুরের ভাষাসৈনিক নজির হোসেন বিশ্বাস

মহাসিন আলী: রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া হলো না। তার আগেই মেহেরপুরের ভাষাসৈনিক নজির হোসেন বিশ্বাস ফেরার দেশে চলে গেলেন। গতকাল শনিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে তিনি নিজ বাসভবন সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের বাড়িতে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি……..রাজেউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ২ মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
মরহুমের ভাতিজা স্কুলশিক্ষক ফিরোজ আহমেদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত ও বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। নানা রোগে অসুস্থ থাকায় তাকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিলো। পরে তাকে বাড়িতে নেয়া হয়। এদিন দুপুর সোয়া ১টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।
গতকাল শনিবার বাদ এশা নামাজে জানাজা শেষে পিরোজপুর গ্রাম্য কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। এদিকে এর আগে মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার লাশে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তৌফিকুর রহমান। এ সময় তার সাথে ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাইন উদ্দীন, পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলহাজ আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ^াস প্রমুখ।
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনের সংসদ সদস্য সাহিদুজ্জামন খোকন, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ গোলাম রসুল, পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটন, ভাষা সৈনিক ইসমাইল হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
পিছন ফিরে দেখা:
মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের ধর্ণাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান নজির হোসেন বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ফয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস ও সরসী নেছা বিবি’র নয় সন্তানের মধ্যে প্রথম নজির হোসেন বিশ্বাস। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৫১ সালে মেহেরপুর মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫১ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভাষার জন্য লড়াই করে পুলিশি নির্যাতন সহ্য করেছেন। অবশেষে তিনিসহ ওই স্কুলের ৭ জন ছাত্র পান রাজ টিকিট। যে কারণে ধর্ণাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও নজির হোসেন বিশ্বাসের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে যায়। তার বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলে আইনজীবী হবে। ইসমাইল হোসেন দারিয়াপুর হাইস্কুলে ভর্তি হয়েও নির্যাতনের শিকার হন। তারপরও তিনি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং স্নাতক পাস করেন।
জীবিত অবস্থায় একান্ত সাক্ষাৎকারে নজির হোসেন বিশ্বাস: ১৯৫২ সালে আমার বয়স ছিলো ১৫ বছর। তখন আমি মেহেরপুর মডেল হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র এবং থাকতাম শহরের মুসলিম হোস্টেলে। তদানিন্তন পাক-সরকারের চাপিয়ে দেয়া উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ঢাকার ৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। এতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে শহীদ হন। ২২ ফেব্রুয়ারি খবরটা মেহেরপুর পৌঁছুলে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা মিছিল বের করি। এরপর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে।
৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস পালনের জন্য মিছিল মিটিং ও পোস্টারিং করি। পুলিশ এতে বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে মিছিল মিটিং ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একই অপরাধে নেতৃত্বদানকারী আমিসহ আমাদের ৭ জনকে পুলিশ আটক করে থানায় নেয়। স্থানীয় জামিনদারদের সুপারিশে রাতে জামিন পাই।
এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাবা আটক হলে বাবার দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নেই। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পিরোজপুর শাখা পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার ছিলাম। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পিরোজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ২০০৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মেহেরপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলাম। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছি দীর্ঘজীবনে। পিরোজপুর গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার মতো জায়গা ছিলো না। তাই ২০০৭ সালে আমি আমার বাড়ির পাশে নিজের নামীয় ৫ শতক জমি মন্দির কমিটির নামে রেজিস্ট্রি করে দিই। ২০১১ সালে ব্রেন স্টোকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছি।
সরকারিভাবে ভাষা সৈনিকের মর্যাদা আমরা পায়নি। তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের লেখালেখির কারণে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় ২০১০ সালে তার নির্দেশে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন ইসমাইল হোসেনসহ আমাদের দু’জনকে ভাষসৈনিক হিসেবে সম্মাননা দেয়। এরপর থেকে জেলা প্রশাসন, মেহেরপুর মৃত্তিকা গ্রুপ থিয়েটার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মক্কর স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সম্মাননা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আরও কয়েকজন মেহেরপুরের ভাষাসৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে সরকারের কাছে আমাদের একটি মাত্র চাওয়ার ছিলো- ‘সারা দেশের শতাধিক জীবিত ভাষাসৈনিককে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক’।
এদিকে প্রায় এক বছর আগে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক আতাউল গনি বলেছিলেন, যেহেতু ৫২’র ভাষাআন্দোলনের হাত ধরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই হিসেবে ভাষাসৈনিক ও ভাষা কর্মীদের অবহেলা করার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, গত ১২ ফ্রেরুয়ারি ২০১৯ মেহেরপুরে আসা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপিকে ভাষাসৈনিকদের স্বীকৃতির বিষয়ে স্মরণ করে দিয়েছি এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ কেবিনেটে বিষয়টি আলোচনার অনুরোধ রেখেছিলাম।