১৩০ কিলোমিটার গতির কোচ চলছে ৬০ কিলোমিটার গতিতে : সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি চলছে ট্রেন
স্টাফ রিপোর্টার: রেলওয়ের উন্নয়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ১৩৭টি নতুন ট্রেন চালু করাসহ প্রায় ৪০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ স্থাপন করা হয়েছে। ১০ বছরে এক হাজার ৪৫০ জন নিয়োগ ও ৭৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অথচ ট্রেনের গতি বাড়ছে না। ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার গতির অত্যাধুনিক কোচ মাত্র ৬০ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলছে। উন্নয়নের গতির সঙ্গে ট্রেনের গতির সঙ্গতি নেই। এক যুগ আগে ঢাকায় ট্রেনের গতি ছিলো ঘণ্টায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে তা কমিয়ে ২৬ থেকে ৩২ কিলোমিটার করা হয়েছে। এমন অবস্থা পুরো রেলপথেই। গতি এভাবে কমে যাওয়ার মূল কারণ- লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো না হওয়া, সেতুগুলোর জীর্ণদশা এবং রেল লাইনের পাথর সরে যাওয়া বা না থাকা, স্টেশন বন্ধ থাকা এবং দক্ষ চালক ও গার্ড স্বল্পতা ইত্যাদি। অন্যদিকে লাইনের সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি ট্রেন চলছে। এতে করে উনিশ থেকে বিশ হলেই লাইনচ্যুতিসহ বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। ঘটছে ভয়াবহ সিডিউল বিপর্যয়। দুর্ঘটনায় কাড়ছে প্রাণ। পঙগু হচ্ছেন শত শত মানুষ।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন জানান, বর্তমান সরকার রেলের ব্যাপক উন্নয়নে কাজ করছে। ইতোমধ্যে বহু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আরও ৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় নিশ্চয় এসব উন্নয়ন প্রকল্পের সুফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পুরো রেলে ডাবল লাইন স্থাপন ও মিটার গেজ লাইনকে ডুয়েল গেজ লাইনে রূপান্তরের কাজ দ্রুত চলছে।
লাইনের অভাবে সক্ষমতার চেয়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন একেকটি লাইনে চলাচল করছে। ডাবল লাইন নির্মাণ, মিটার গেজকে ডুয়েল গেজ লাইনে রূপান্তর শেষে সিডিউল বিপর্যয় শব্দটিই রেলে আর থাকবে না। রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে আমরা বিশেষ নজর দিয়েছি। ইতোমধ্যে ১৬টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রেলপথকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন আনা অত্যাধুনিক কোচ দিয়ে আমরা অন্তত ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালাতে পারবো।
মন্ত্রণালয়সূত্র জানায়, ১১ বছরে যাত্রী পরিবহন বেড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। একই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ ১৬৫৮ শতাংশ বেড়েছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে প্রায় ৪০০ অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ করা হয়েছে। ৯৫টি নতুন রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় রোধ করতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
যে উদ্দেশে অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচগুলো আনা হয়েছিলো সেগুলো নির্ধারিত গতি নিয়ে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় কিছুতেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী কোচ দ্বারা ট্রেন চালাতে গিয়ে উনিশ থেকে বিশ হলেই লাইনচ্যুত কিংবা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও দুর্ঘটনা কমছে না। সিডিউল বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়ে কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় বছরের পর বছর ধরে চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে চলা অধিকাংশ ট্রেন ২ থেকে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলাচল করছে। ঢাকার সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলে চলা বনলতা এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস, সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস, রাজশাহী এক্সপ্রেস, টাঙ্গাইল এক্সপ্রেস ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় নিয়মে দাঁড়িয়েছে।
১১ বছরে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা করা হলেও গতি বাড়েনি ট্রেনের। সেবা না বাড়লেও ওই সময়ের মধ্যে ট্রেনের ভাড়া দুই দফা বেড়েছে। এরপরও বাড়ছে লোকসান। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলে লোকসান হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে লোকসান দাঁড়াবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এমন ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য অনুসারে, বর্তমানে রেলে ৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। এসব প্রকল্পে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। কিছু মাঝপথে আছে আর কিছু প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রেলে উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। অত্যাধুনিক প্রায় ৪০০টি যাত্রীবাহী কোচ আনা হলেও রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোচগুলো দিয়ে ১২০-১৩০ গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ডাবল লাইন তৈরি কিংবা ডুয়েল গেজ লাইন তৈরি না করেই ১৩৭টি ট্রেন উদ্বোধন করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে বর্তমানে যে রেলপথ রয়েছে তা দিয়ে ২০ থেকে ২২টি ট্রেন প্রতিদিন চালানোর সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর কারণে সক্ষমতার বাইরে ২৪টি ট্রেন প্রতিদিন চলছে। অর্থাৎ সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ট্রেন চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
রেলওয়ের সহকারী পরিচালক (অপারেশন) মো. সাইয়েদুর রহমান জানান, বিশেষ করে ঢাকার সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনগুলো বিলম্বে চলাচল করছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সিডিউল বিপর্যয় কমিয়ে আনতে। কিন্তু, পশ্চিমাঞ্চলে অধিকাংশ রেলপথই সিঙ্গেল লাইনের। অন্যদিকে, পশ্চিমাঞ্চলে অনেক নতুন ট্রেন চালানো হয়েছে। বন্ধ স্টেশনের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পশ্চিমাঞ্চল রেলে। বন্ধ স্টেশন এলাকায় ১০-১৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালাতে হয়। সিঙ্গেল লাইন ও অতিরিক্ত ট্রেনের কারণে একটি ট্রেন দাঁড় করিয়ে অন্য একটি ট্রেনকে পাস দিতে হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর সিঙ্গেল লাইন দিয়ে ট্রেন চালাতে গিয়ে একেকটি ট্রেন আধা ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। সেতুর উভয় পাশে পুরো ট্রেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আরও ১০ মিনিটের মতো সময় লাগে।
বেশ কয়েকজন রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিদেশি ঠিকাদার দ্বারা চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। বিদেশি ঠিকাদাররা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় যেমন বাড়াচ্ছে প্রকল্পের ব্যয়ও তেমন বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, বিপুল অর্থ পেয়ে রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। এজন্য রেলপথ, সাধারণ ইঞ্জিন ও বগি সংকট দূর না করে সবার আগে চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়। ডেমু এখন রেলের অজনপ্রিয় খাত। এসব ট্রেনে যা আয় হচ্ছে তার প্রায় তিনগুণ বেশি খরচ হচ্ছে। এদিকে, আন্তঃনগর ট্রেন কোন স্টেশনে থামবে আর কোন স্টেশনে থামবে না সবকিছুই রাজনৈতিক ও ব্যক্তি বিবেচনায় করা হচ্ছে। এতে করে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় বাড়ছে। রেল নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- রেলের দুরবস্থার পেছনে তিনটি বড় কারণ রয়েছে। এগুলো হলো দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ।
রেলওয়ের মহাপরিচালক শামছুজ্জামান জানান, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে এমনটা নয়। যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ধীরগতিতে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান রেলপথ দিয়ে সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ট্রেন চলাচল করছে। এমন অবস্থায় যথাযথ গতি নিয়ে ট্রেন চালাতে গেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকা ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনগুলো বিলম্বে চলাচল করছে। তবে আগামী কয়েক বছরে এমন অবস্থা থাকবে না। বিদেশি ঠিকাদারের চেয়ে দেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভালো কাজ করছে। তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা রয়েছে। প্রকল্পের কাজও তারা দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছেন। চলমান প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সমাপ্ত হলে সিডিউল বিপর্যয় একেবারেই থাকবে না।