আলমডাঙ্গা ব্যুরো: কেমন আছেন আলমডাঙ্গা উপজেলার ৫৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসার লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা। সে খবর কেউই রাখেন না। সরকার যেমন পদ সৃষ্টি করে নিয়োগের ব্যবস্থা করলেও বেতন দিতে ভুলে গেছেন, তেমনি ভুলেছেন নিয়োগদানকারী এসএমসি কর্তৃপক্ষ। ৪/৫ বছর বিনা বেতনে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করতে করতে অনেকেই হারাচ্ছেন এমপিও ভুক্তির আশা।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার অব্যহিত সময় পরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রত্যেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও মাদরাসায় লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রুততর সময়ের মধ্যে এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করা হয়। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো হামলে পড়েন এসএমসি। কে কার আগে নিয়োগ দিতে পারেন সেই অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। একদিকে বেকারত্বের অভিশাপে জর্জড়িত যুবসমাজ, অন্যদিকে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ ছাড়াই সিনিয়র শিক্ষকের বেতন স্কেলের লোভনীয় অফার। ফলে চাকরি প্রার্থীর মোটেও অভাব হয়নি। ৪/৫ লাখ টাকা দিয়ে লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরি নেয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রার্থীদের একবারও ভেবে দেখার ফুরসত মেলেনি। দেখতে না দেখতেই সারাদেশের মতো আলমডাঙ্গা উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ হয়ে যায়। এরপর থেকে শুধুই অপেক্ষার পালা কখন বেতন বের হবে। এভাবেই কাটাচ্ছে প্রায় ৫ বছর। অথচ এমপিও ভুক্তির মাহেন্দ্রক্ষণ আর ভাগ্যে জোটেনি তাদের। অনেকেই জমি-জমা বিক্রি করে, ব্যাংক- এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ৪/৫ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতায় উতরেছে। ৩ বছর বেতন না পেয়ে তাদের অবস্থা কতোটা অমানবিক তা শুধু ভুক্তভোগিরাই জানেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বছর তিনেক আগে লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগপ্রাপ্ত এক যুবক জানিয়েছেন, তিনি নিম্নমধ্যবৃত্ত পরিবারের সন্তান। বেশ কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন। সংসারে ৩ বছরের ১টি সন্তান আছে। পৃথক হওয়ার সময় মাঠের আবাদযোগ্য মাত্র আড়াই বিঘা জমি পেয়েছিলেন। তাই চাষাবাদ ও ছোট-খাটো ব্যবসা করতেন। কিন্তু লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ পেতে তার প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। দেড় বিঘা জমি বিক্রি করেছেন। বাকি জমি বন্দক রেখেছেন। এছাড়া ব্যাংক ও এনজিও থেকে লোন নিয়েছেন। তাও টাকার সংকুলান হয়নি। মন্ত্রণালয়ে এমপিওভুক্তির জন্য আত্মীয়স্বজনের নিকট থেকে কর্জ করে ৫০ হাজার টাকা আনতে হয়েছে।
নিয়োগপ্রাপ্তির দেড় ২ বছর অতিবাহিত হতে চললো, এখনো তার বেতন হয়নি। তিনি যে বিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন, সেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সর্বসাকুল্যে পৌনে ৩ শ’। ফলে বিদ্যালয় থেকে কোনো বেতন-ভাতা পাওয়ার অবকাশ নেই। শিক্ষার্থীদের বেতন ও পরীক্ষার ফি বাবদ যা আদায় হয়, তাতে কোনো রকমে বিদ্যালয়ের খরচ, বোর্ডের নানা রকম উৎকোচ ও প্রধান শিক্ষকের ভাউচারে শেষ হয়। ফলে বিদ্যালয় থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা পান না। তিনি বর্তমানে যে কী নিদারুন ও অবর্ণনীয় কস্টে আছেন তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে, আত্মীয়ের নিকট অপমানিত হওয়া, অভাব অনটনের সংসারের জ্বালা, অন্যদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের তাগাদা। আগে জানলে এ অনিশ্চয়তার চাকরি তিনি কিছুতেই করতে আসতেন না। যে সকল বিদ্যালয়ের অবস্থা বেশ ভালো, সেখানেও লাইব্রেরিয়ানরা ভালো নেয়। টিচিং স্টাফ না হওয়ার কারণে ও এমপিভুক্ত হয়নি বলে নানা রকম সুবিধা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়।
আলাপকালে অনেক নিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানরা জানান, এমপিওভুক্তির জন্য ২ বছর/আড়াই বছর আগে ৫০ হাজার করে ঘুষ দিয়ে রেখেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু কবে নাগাদ বেতন বের হবে তা কেউই বলতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট অফিসও কিছু জানেন না। এ সম্পর্কে জনপ্রতিনিধিরাও বেদনাদায়কভাবে নীরবতা পালন করে চলেছেন। যেন তাদের দায় ছিলো শুধু নিয়োগ দেয়া পর্যন্ত। এ বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির আচরণও নেতিবাচক। তারাও খোঁজখবর রাখেন না। কীভাবে বেতনবিহীন জীবনযাপন করছেন লাইব্রেরীয়ানরা? আর কতোদিন মানবেতর অবস্থায় চাকরি করতে হবে তাদের? দায়িত্ব পালন করতে হবে মানুষ গড়ার কারিগরের?