প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে ৫৫ জেলায় নারী কোটা পূরণ হয়নি

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশের বেশি নারী নিয়োগের বিধি থাকলেও তা হয়নি মানা

স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশের বেশি নারী শিক্ষক নিয়োগের বিধি থাকলেও তা মানা হয়নি। নারীর চেয়ে বেশি পুরুষ প্রার্থী নিয়োগের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। মাত্র ৪৭ শতাংশ নারীকে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। আর ৫৩ শতাংশ নির্বাচিত হয়েছেন পুরুষ শিক্ষক। অথচ পুরুষ শিক্ষকের কোটা ২০ শতাংশ। আর পোষ্য কোটা ২০ শতাংশ। দেশের বিভিন্ন জেলার পরিসংখ্যান অনুসারে, ৬১ জেলার মধ্যে ৫৫ জেলায়ই নারী কোটা পূরণ হয়নি। পূরণ হয়েছে মাত্র ছয়টি জেলায়। ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার ১৮ হাজার ১৪৭ জন প্রার্থী নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন। এর মধ্যে নারী শিক্ষক ৮ হাজার ৫৭০ জন যা মোট প্রার্থীর ৪৭ শতাংশ। আর পুরুষ প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন ৯ হাজার ৫৭৭ জন যা উত্তীর্ণ প্রার্থীর ৫৩ শতাংশ। ৬০ শতাংশ নারী কোটা নিয়োগ দেয়া হলে এ সংখ্যা হতো ১০ হাজার ৮৮৮ জন। সে হিসাবে নারী কম নির্বাচিত হয়েছেন ২ হাজার ৩১৮ জন। নারী কোটা পূরণ না হওয়ায় এরই মধ্যে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশনও দায়ের করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার নারী প্রার্থীদের কোটা পূরণ না হওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একাধিক রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। দায়েরকৃত এই রিটের শুনানি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত। ১০ দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে গতকালও বুধবার হাইকোর্ট নীলফামারী ও বরগুনার চূড়ান্ত ফল ছয় মাসের জন্য স্থগিত এবং ফল বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করেছে আদালত। এই দুটি জেলায়ও নারী কোটা পূরণ করা হয়নি। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ এ রায় দেয়। ফলে এ নিয়োগ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, নারী শিক্ষক কম নির্বাচন করা হলেও বিধিমালা ব্যত্যয় হয়নি। কারণ ঐ সব জেলায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। তারা নিয়োগ নীতিমালার দ্বিতীয় অংশের যুক্তি তুলে ধরে বলেন, নীতিমালায় বলা আছে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ প্রার্থীদের দ্বারা পূরণের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, রিট পিটিশন দায়ের করার পর এখন আমাদের কী করণীয় তা বসে ঠিক করা হবে। রুলের জবাব দেয়া হবে। যে উপজেলায় ফল নিয়ে রিট পিটিশন হয়েছে শুধু সেসব জেলার নিয়োগ ছাড়া অন্য কোথাও নিয়োগে বাধা আছে বলে মনে করি না।
রিট পিটিশনারদের আইনজীবী মো. কামাল হোসেন ও রেজাউল করিম রেজা ইত্তেফাককে জানান, এই নিয়োগে ৬০ শতাংশের বেশি নারী নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হবার কথা। কিন্তু ৬০ শতাংশ পূরণ হয়নি। নারীর চেয়ে পুরুষই বেশি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০ শতাংশ যে পোষ্য কোটা রয়েছে সেখান থেকেও নারী নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হবার কথা। কিন্তু পোষ্য কোটা আলাদাভাবে না দেখানোয় সেখানেও নারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
আর মানবাধিকার কর্মী ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশি কবির বলেন, ৬০ ভাগ যোগ্য নারী শিক্ষক পাওয়া যায়নি এটা একটা খোঁড়া অজুহাত। এটা আমি মেনে নিচ্ছি না। যখন ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে তখন ৬০ শতাংশ যোগ্য নারী রয়েছেন বলেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাহলে পরীক্ষার পর যদি বলা হয়ে থাকে যোগ্য নারী শিক্ষক পাওয়া যায়নি এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অনেক নিয়োগ হয়ে থাকে এ কারণে নারীরা পিছিয়ে থাকে। এ আর্থিক লেনদেনে নারীরা জড়িত থাকেন না, থাকতে পারেন না।
আসমা আক্তার নামে এক প্রার্থী বলেন, নারী প্রার্থীদের বঞ্চিত করার জন্য নীতিমালায় নতুন বাক্য যুক্ত করা হয়েছে। তিনি নীতিমালা পরিবর্তনের দাবি জানান। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১ হাজার ৭৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ১ হাজার ১৯ জন। আর নারী ৭৪৭ জন। খুলনা বিভাগের একটি জেলায়ও নারী কোটা পূরণ হয়নি।
চট্টগ্রাম বিভাগের ৮ জেলায় ৩ হাজার ৮২৫ জন শিক্ষক নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ৬০ শতাংশ দূরের কথা মোট উত্তীর্ণের মধ্যে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। পুরুষ নির্বাচিত হয়েছেন ২ হাজার ১৮৩ জন। আর নারী ১ হাজার ৬৪২ জন। ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে মাত্র ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় নারী কোটা পূরণ হয়েছে। বাকি ৯টি জেলায় পূরণ হয়নি। ৩ হাজার ৭১৩ জন নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৮ জন নারী এবং ১ হাজার ৭০৫ জন পুরুষ। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার কোনোটিতেই নারী কোটা পূরণ হয়নি। ১ হাজার ৯৪৯ জন নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ৮৮৮ জন নারী এবং ১ হাজার ৬১ জন পুরুষ। ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলার মধ্যে ২টিতে নারী কোটা পূরণ হয়েছে। ১ হাজার নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ৫০৮ জন নারী এবং ৪৯২ জন পুরুষ। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার একটিতেও নারী কোটা পূরণ হয়নি। ২ হাজার ৪২২ জন নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ২৯১ জন পুরুষ এবং ১ হাজার ১৩১ জন নারী। রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে সবটিতেই নারীর চেয়ে বেশি পুরুষ প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিভাগে ১ হাজার ৯০৯ নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে পরুষ ১ হাজার ৭৪ এবং মহিলা ৮৩৫ জন। আর সিলেট বিভাগের চিত্র একই। ১ হাজার ৫৩৬ শিক্ষকের মধ্যে নারী ৮১১ জন এবং পুরুষ প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন ৭৫২ জন।
গত বছরের ৩০ জুলাই সহকারী শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকার। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর সারাদেশ থেকে ২৪ লাখ প্রার্থী চাকরির জন্য আবেদন করেন। চার ধাপে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে ফল প্রকাশ করা হয়। এতে ৫৫ হাজার ২৯৫ জন পাস করেন। এই পরীক্ষায় ৬১ জেলায় ১৮ হাজার ১৪৭ জন নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি নতুন শিক্ষকদের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে যোগদান করার কথা।