ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আর আহার জোগানোর তাগিদে দিশেহারা চুয়াডাঙ্গার অধিকাংশ দিনমজুর

তীব্র শীতে প্রকৃতিও যখন যবুথবু তখনও স্বল্প শীতবস্ত্র গায়ে জড়িয়ে মানুষ বিকোন হাটে ওরা জড়োসড়ো

আনোয়ার হোসেন: তখনও সকাল হতে অনেক বাকি। ঘনকুয়াশার চাদরে ঢাকা আশ-পাশ। কনকনে শীত। ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। এ অবস্থাতেও অল্প কিছু শীতবস্ত্র গায়ে জড়িয়ে দিনমজুরদের ছুটতে হয় কাজের সন্ধানে। এতো শীতে অতো কষ্ট করে শ্রম-বিকোন মানুষের হাটে উঠেও কি ওরা পাচ্ছেন কাজ? কেনই বা ওদের বৈরি আবহাওয়াতেও দিনমজুরির জন্য ছাড়তে হয় ঊষ্ণ বিছানা? এসব প্রশ্নের জবাব জানতে গতকাল ভোরে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাসান চত্বরের একপ্রান্তের মানুষের হাটে সরেজমিন গেলে পাওয়া যায় ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি জোগাড়ের তীব্র তাগিদ আর অনাহারের হাত থেকে পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করার অন্তহীন আকাক্সক্ষার করুণ চিত্র।
কে বলেছে অনাহারি নেই? কে বলেছে কেটে গেছে দুস্থের কষ্ট? চুয়াডাঙ্গায় যখন তাপমাত্রা নেমেছে দশের নিচে তখনও দিনমজুরদের কাজের আশায় অনিশ্চয়তার প্রহরগুনার দৃশ্য দেখে এসব প্রশ্ন এখন সাধারণ পথচারীদের অনেকের। চলতি শীত মরসুমে দ্বিতীয় দফায় মৃদু শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের বেশকিছু এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘনকুয়াশা আর বিকেল থেকে পরদিনের সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত কনকনে শীতে মূলত জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এবস্থার মধ্যেও গতকাল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বরের শহীদ আবুল কাশেম সড়কের ধারে কাজের জন্য অপেক্ষায় থাকা প্রায় অর্ধশত দিনমজুরের সাথে কথা হয় তাদের জীবনযাত্রার খ-াংশ নিয়ে। এদের অধিকাংশের ওপরই রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের বোঝা। তার ওপর দিনমজুরি না হলে পরিবারের সদস্যদের অনাহারে থাকার আশঙ্কা। ফলে শীত যতোই তীব্র হোক, কষ্ট যতোই কাবু করুক মনবল নিয়ে কাজের জন্য রাস্তায় ওদের বের হতেই হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েও ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি? ঋণ নেয়া টাকাগুলো কোথায় কীভাবে খরচ হয়েছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে দিন মজুরির অপেক্ষায় থাকা খেটেখাওয়া মানুষগুলোর সামনে দাঁড়ালে তাদের মধ্যে গাড়াবাড়িয়ার আব্দুল হামিদ বললেন, ‘যে শীত পড়ছে তাতে বেঁেচ থাকাই কষ্ট। এরপরও কাজের জন্য বের হয়েও কাজ জুটছে না। দশদিনের প্রতিদিনই ভোরে ঝুড়ি কুদাল নিয়ে এই চৌরাস্তার মোড়ে এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। ১০দিন অপেক্ষার পর সোমবার কাজ জুটেছিলো। মজুরি হিসেবে পেয়েছিলাম ৩শ ৫০ টাকা। আজ সেই ভোরে এসে বসেছি। এখনও জানিনা কাজ জুটবে কিনা।’ প্রতিদিন কাজ করতেই হবে কেন? গোচ্ছিত কিছু নেই? এসব প্রশ্নের জবাবে হামিদের স্পষ্ট বক্তব্য- সামনের দিনগুলো ভালো হবে ভেবে এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণের টাকা দিয়ে একটি গরু কিনে পালছি। আর কাজ করে ঋণের কিস্তি দেয়ার চেষ্টা করছি। দিনমজুরি না হলে কিস্তি দেবো কীভাবে? আর বাড়ির লোকজন খাবেই বা কী? পাড়ার দোকানেও একের পর এক ধার দেনা বেড়েছে। ওই দোকানদারই বা কতোদিন বাকি দেবে? কাজ না পেলে বাড়ির লোকজনকে নিয়ে না খেয়েই থাকতে হয়। একথা কি বাইরে বলা যায়। অভিন্নভাষায় প্রায় একই ধরনের জীবনযুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে একই গ্রামের বেল্টু বললেন, শীতের শুরু থেকে এক মাসে হাতে গোনা ৪/৫দিন কাজ পেয়েছি। ওতে কি সংসার চলে। তবে শীতের পর ফাগুনে আবার আমাদের কাজ বাড়বে। তখন আর এখনকার মতো এতো কষ্ট থাকবে না। একই স্থানে একই উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে থাকা উজিরপুরের সিদ্দিকুর রহমান অবশ্য বললেন, দিনমজুরি করছি সংসারে স্বচ্ছ্বলতা আনার জন্য। দিনমজুরি করলে দুপুরের মধ্যে কাজ শেষ হয়। বাড়ি ফিরে নিজের সামান্য জমিসহ গোবাদি পশুপালনে সময় দেয়া সহজ হয়। দিনমজুরি না পেলে সামনের দিন সুন্দর করবো কীভাবে? গড়াবাড়িয়ার হাফিজুর রহমানের ঘাড়ে রয়েছে ৩০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা। এছাড়াও রয়েছে পাড়ার দোকানের দায় দেনা। ঋণসহ দায় দেনা হয়েছে মেয়ের বিয়ের মধ্যে। ঋণের কিস্তি আদায়কারীদের আচরণের কথা মনে হলে যতো কষ্টই হোক অসুস্থ হলেও বাড়ি বসে থাকার জো নেই। উজিরপুরের জাফর আলী বললেন, এক সময় কাজ না পেয়ে দোকানে দেনা দায় হয়। সেই দেনা দিতে গিয়ে এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকার ঋণ নেয়া হয়। সেই ঋণের কিস্তির জন্য এখন শীত গরম দেখলে চলে না। একদিকে ঋণ পরিশোধের সাপ্তাহিক কিস্তি, অপরদিনে রোজ দু’বেলা দুমোঠা খাবার। আমাদের কি শীতে বাড়ির ধূকড়ায় পা ঢেকে বালিসে কেনো দিয়ে গিন্নির সাথে গল্পকরা মানায়! ঠেলা নিয়েই খেতে হয়।
তীব্র শীতের ভোরেদিন মজুরদের দশা শুনে সঙ্গতঃ প্রশ্ন উঠেছে পাশে থাকা এক প্রাতঃভ্রমণকারীর। তিনি বললেন, এনজিওগুলোর দেয়া চড়াসূদের ক্ষুদ্রঋণ সমাজের দারিদ্য বিমোচনে কতটা অবদান রাখছে নাকি অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নতুন করে খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রসঙ্গত: গতকাল দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা তেতুলিয়ায় ৬ দশমিক শূন্য ও সর্বোচ্চ টেকনাফে ২৭ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। চুয়াডাঙ্গায় সর্বনি¤œ ১০ দশমিক ২ ও সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, তাপমাপা যন্ত্রের পারদ যতোটুকুই নামুক আর না নামুক শীতে কাপছে প্রাণিকূল।