স্টাফ রিপোর্টার: গুলশানে আলোচিত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করবেন। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকেই ঢাকার আদালত চত্বর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। নিরাপত্তার এ অবস্থা পর্যবেক্ষণে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার আদালত পাড়া পরিদর্শন করেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মীর রেজাউল আলম ও কৃষ্ণপদ রায়। পরিদর্শন শেষে তারা আদালত পাড়ার বিশেষ নিরাপত্তায় লালবাগ ডিভিশন ও আদালতের ডিসি প্রসিকিউশনকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। রায় শুনতে আদালতে যাবেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। এছাড়া যেসব দেশের নাগরিক নিহত হয়েছেন সেই দেশের ঢাকার কূটনীতিকদের রায় শুনতে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেই রাতে নিহতের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার একটি আর্ট গ্যালারির সাবেক প্রধান ইশরাত আখন্দ। তার ভাই ড. ইউসুফ আখন্দ বলেন, ‘মূল হত্যাকারীদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছে, এখন আসামি যারা আছে, তারা পরিকল্পনাকারী বা সহযোগী। তাদের যথাযথ শাস্তি হবে বলেই আমরা আশা করি। আমার মা এখনও প্রতি রাতে মেয়ের জন্য কাঁদেন। সে তো আর কোনোভাবেই ফিরে আসবে না। তবে আর কেউ যেন এমন নৃশংস কর্মকা-ে উৎসাহিত না হয়, সেজন্যই কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। সামাজিকভাবেও তাদের প্রতিহত করতে হবে।’ তিনি জানান, হামলাকারী প্রায় সবাই শিক্ষিত ও ভালো পরিবারের সন্তান ছিলো। সেক্ষেত্রে কেন তারা এমন একটি ঘটনা ঘটাল, প্রকৃত ঘটনা কী ছিলো, এর কারণ ও উৎস ভালোভাবে খুঁজে দেখা দরকার। হামলায় নিহত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন সহকারী কমিশনার রবিউল করিম কামরুলের স্ত্রী উম্মে সালমা বলেন, ‘নৃশংস ওই জঙ্গি হামলায় অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। আমার সন্তান হারিয়েছে তার বাবাকে। তাদের অভাব পূরণ হওয়ার নয়। তাই আমার চাওয়া, এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, মৃত্যুদ- দেয়া হোক।’
উম্মে সালমা জানান, জঙ্গি হামলা ঠেকাতে গিয়ে মারা যাওয়ায় বিভিন্ন সময়ে তার স্বামীকে শহীদ আখ্যা দেয়া হয়েছে। তার সন্তানদের বলা হয়েছে শহীদের সন্তান। তবে এখন পর্যন্ত এটা রয়েছে মুখে মুখে। তাই বিচারের রায়ে বা সরকারের উদ্যোগে যেন দাফতরিকভাবে শহীদের স্বীকৃতি মেলে। আর রবিউলের স্বপ্ন ছিলো সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা। এই লক্ষ্যে তিনি মানিকগঞ্জের কাটিগ্রামে ‘বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি’ বা ব্লুমস নামে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তার অনুপস্থিতিতে এই স্কুলটি চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন স্বজনরা। সরকার এই স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্ব নিলে বেঁচে থাকতো রবিউলের স্বপ্ন।
বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খানের স্ত্রী রিম কিম জানান, এই দেশ ও দেশের মানুষকে খুব ভালোবাসতেন তার স্বামী। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের মানুষের জন্যই তিনি প্রাণ দিয়েছেন। তাই দেশের মানুষ যা চায়, সেটাই তার (রিম কিম) চাওয়া। সবাই চায় জঙ্গিদের ফাঁসি হোক। সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। তিনিও তাই চান। নিহত অবিন্তা কবীরের স্বজনদের কেউ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। অবিন্তা কবীর ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ত্রপা বলেন, ‘ম্যাডামের (অবিন্তা) মা রুবা আহমেদ এ প্রসঙ্গ উঠলেই খুব কষ্ট পান। এটা তার জন্য মানসিক পীড়ন। তাই তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না। তার বক্তব্য, যে চলে গেছে সে তো আর কিছুতেই ফিরে আসবে না। কথা বলে লাভ কী!’ হলি আর্টিসান হামলা মামলার সরকারি কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান জাকির বলেন, ‘এ মামলায় ২১১ সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এই বক্তব্যে সকল আসামির ভূমিকা উঠে এসেছে। রায়ে ৮ জঙ্গির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- প্রত্যাশা করছি।’
ঘটনাক্রম: ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন দেশি-বিদেশি ২০ জন। হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা এএসপি রবিউল করিম এবং ওসি সালাউদ্দিন খান নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। তারা হলো রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামীহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রেস্তোরাঁর কর্মী সাইফুল। হলি আর্টিসান মামলার তদন্ত শেষে ওই ঘটনায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা মিলে। তাদের আসামি করে গত বছরের ২৩ জুলাই চার্জশিট দেয় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তারা হলো মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, রায়হান কবির ওরফে তারেক, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ। তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় পুলিশ-র্যাবের অভিযানে ১৩ জঙ্গি নিহত হয়। তাই চার্জশিটে তাদের নাম রাখা হয়নি। চার্জশিটভুক্ত জীবিত ৮ আসামি হচ্ছে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদুল ইসলাম রাশেদ, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম খালেদ, মামুনুর রশিদ রিপন ও আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা সোহেল। গত বছরের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ৮ জঙ্গির বিচার।
নিরাপত্তা জোরদার: রায় ঘিরে ঢাকার আদালতপাড়ায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গতকাল রাত থেকেই আদালতপাড়া এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় নেয়া হয়। এছাড়া দেশব্যাপী থাকছে বাড়তি নজরদারি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার আদালতপাড়া পরিদর্শন করেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় ও মীর রেজাউল আলম। পরিদর্শন শেষে তারা আদালতপাড়ার বিশেষ নিরাপত্তায় লালবাগ ডিভিশন ও আদালতের ডিসি প্রসিকিউশনকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।
তবু সতর্ক পুলিশ: হলি আর্টিসান হামলার পর জঙ্গিদের তৎপরতা কমলেও সতর্ক পুলিশ। ২০১৩ সালে চারটি জঙ্গি হামলায় ৯জন, ২০১৪ সালে পাঁচটি ঘটনায় তিনজন, ২০১৫ সালে ২৩টি ঘটনায় ২৫ জন, ২০১৬ সালে ২৫টি ঘটনায় ৪৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসানে হামলার ঘটনাও রয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। সে বছরের জুনে লেখক-প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করে তারা। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ঢাকায় পাঁচটি হামলার ঘটনা ঘটেছে।