স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে হত্যাকাÐে সরাসরি অংশ নেয় ১১ জন। ঘটনাস্থলে উপস্থিতি এবং অন্যভাবে সম্পৃক্ততার কারণে বাকি ১৪ জনকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অভিযুক্ত সবাই বুয়েটের ছাত্র (১৯ জন সাময়িক বরখাস্ত)। এছাড়া তারা বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীও। তাদের ১২ জনকে ইতিমধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান। এরপর বিকেলে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. কায়সারুল ইসলামের আদালতে চার্জশিটটি দাখিল করা হলে আদালত তা দেখেন। মামলার বিচারের লক্ষ্যে শিগগিরই এ চার্জশিট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হবে। হত্যা ঘটনার ৩৭ দিনের মাথায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করল ডিবি।
ডিবি পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে- অভিযুক্তরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত ছিলো। তারা রাজনৈতিক পরিচয়কে শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করে অছাত্রের মতো আচরণ করতো। বুধবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম এ তথ্য জানান। তিনি আরও বলেন, হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরেকটু মনিটরিং করলে এ ঘটনা এড়ানো যেতো। তদন্তে আমরা তাদের ব্যর্থতা দেখেছি।’ এ মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে চারজন পলাতক আর ২১ জন কারাগারে। তাদের মধ্যে ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন। বাকি ১৩ জনের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জসিম উদ্দীন জানান, চার্জশিটে ২১টি আলামত ও ৮টি জব্দতালিকা যুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যায় তদন্ত সংস্থা যে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তা ‘নির্ভুল হয়েছে’ মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন শিগগিরই এর বিচার হবে, আমরাও এটা আশা করছি। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সব আইনি বাধ্যবাধকতা শেষ করে আবরার হত্যা মামলার দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনালে করা হবে। এদিকে দ্রæত সময়ের মধ্যে চার্জশিট দেয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে আবরারের পরিবার। তারা এখন দ্রæত সময়ের মধ্যে খুনিদের শাস্তি দেখতে চান।
সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন আবরারের বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ ২১ জনকে গ্রেফতার করে। তিনি জানান, আবরার ফাহাদকে হত্যায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন ১১ জন। তারাই তাকে কয়েক দফায় মারধর করেন। বাকি ১৪ জন বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে এ হত্যাকাÐে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, চার্জশিটে ৩১ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে বাদী পক্ষের ৬ জন ছাড়াও বুয়েটের সাতজন শিক্ষক, ১৩ জন শিক্ষার্থী এবং ৫ জন কর্মচারী রয়েছেন।
তিনি বলেন, গ্রেফতার ২১ জনের মধ্যে ১৬ জনের নাম আবরারের বাবার করা হত্যা মামলার এজাহারে আছে। অন্য পাঁচজনের নাম তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। চার্জশিটভুক্ত ২৫ জনের মধ্যে চারজন পলাতক। তাদের মধ্যে জিসান, তানিম ও মোর্শেদের নাম মামলার এজাহারে আছে। আর এজাহারের বাইরে পলাতক আরেক আসামি রাফি।
অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদকে কোনো একক কারণে হত্যা করা হয়নি। আবরার শিবির করেন কি না, হত্যার পেছনে এটি একটি মাত্র (অন্যতম) কারণ। কিন্তু যারা তাকে হত্যা করেছে, তারা এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। কেউ তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে, সালাম না দিলে, তাদের সামনে হেসে দিলে ইত্যাদি কারণে নির্যাতন করতো।
তিনি বলেন, আসামিদের ভাষ্যমতে, আবরার ফাহাদ দেখা হলে বড়দের সালাম দিতো না। বিভিন্ন তির্যক মন্তব্য করতো। আগে থেকেই তারা নানা কারণে আবরার ফাহাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলো। অনেক বিষয়ের সমষ্টিতেই আবরার ফাহাদকে পেটানো হয়।
একজনকে মেরে অন্যজনকে শিক্ষা দিতে কিংবা জুনিয়রদের মধ্যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে তারা দীর্ঘদিন র্যাগিংয়ের নামে এ ধরনের কর্মকাÐ চালিয়ে আসছিলো। যার আচরণ অপছন্দ হতো, তাদেরই ডেকে এনে নানা নির্যাতন করা হতো। অন্য কেউ এমন অভিযোগ করলেও আমরা বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখবো।
মনিরুল বলেন, অভিযুক্তরা র্যাগিংয়ের নামে নতুনদের আতঙ্কিত রাখতে এসব কাজ করত। এসব বিষয়ে আমরা আগে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে তদন্তে একজন সাক্ষী বলেছেন যে তিনি একজনকে সালাম দেননি বলে তাকে পেটানো হয়েছে। র্যাগিংয়ের নামে উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাÐের অভ্যস্ততার অংশ হিসেবেই আবরার হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। তিনি বলেন, হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকে মনিটরিং করলে এমন ঘটনা না-ও ঘটতে পারতো। এটা তাদেরই মনিটরিং করার কথা।
মনিরুল ইসলাম বলেন, তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি, রাত ১০টার পর থেকে আবরারের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ২টা ৫০ মিনিটের দিকে ডাক্তার তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন। দীর্ঘ সময় তাকে পেটানো হয়। তাকে হয়তো একটু আগে হাসপাতালে নিয়ে গেলে এমন নৃশংস পরিণতি হতো না।
মনিরুল বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যায় যারা রড দিয়ে পিটিয়েছিলো, তাদের ফাঁসি হয়েছে। অভিযুক্ত কয়েকজন আবার খালাসও পেয়েছে। সেই মামলায় আমরা তেমনভাবে সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি। এ ধরনের ঘটনা প্রমাণের জন্য ট্রেডিশনাল তদন্ত বা চাক্ষুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। আবরার হত্যাকাÐের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন, তদন্ত সহায়ক দল ছিলো, সিসিটিভি ফুটেজ, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ, ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রæপের তথ্য রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ, পাশাপাশি ৮ জন আসামির বক্তব্যও হত্যাকাÐের অনেক বিষয় প্রমাণ করে। যদিও এ ধরনের ঘটনায় চাক্ষুষ সাক্ষী থাকলেও সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসে না। কিন্তু আমরা যেভাবে চার্জশিট প্রস্তুত করেছি, আশা করছি সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে। তিনি জানান, আবরারকে নির্যাতনে ব্যবহৃত পাঁচটি ক্রিকেট স্টাম্প, একটি স্কিপিং রোপ, দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিডি, পাঁচটি মোবাইল ফোন এবং একটি ল্যাপটপ এ মামলার আলামত হিসেবে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে একটি ভিডিও দেখানো হয় পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে।
আবরার হত্যায় অভিযুক্ত যারা: আবরার হত্যায় অভিযুক্তরা হলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ), এএসএম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ)। তারা আবরারের বাবার মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি। আর এজাহারের বাইরের ৬ আসামি হলেন: বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপদফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।
পলাতক ৪ জন হলেন: এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ) এবং মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল)।
যে আটজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন: যে ৮ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারা হলেন- মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, এএসএম নাজমুস সাদাত এবং খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর। আদালতের কাছে তাদের দেয়া বর্ণনায় উঠে আসে আবরারকে পেটানোর সেই ভয়ংকর বিবরণ।
আবরারকে কীভাবে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা বেধড়ক পেটানো হয়েছিলো, তার বর্ণনা ডিবি পুলিশ ও আদালতের কাছে স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দেন এ ৮ জন। আবরারকে সেদিন রাতে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়।
হত্যার ঘটনায় সরাসরি ১১ জন: হত্যার ঘটনায় যারা সরাসবি জড়িত ছিলেন তারা হলেন- মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, শামীম বিল্লাহ, এএসএম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিম এবং খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর।