স্টাফ রিপোর্টার: জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এতে ছয় জেলায় সহিংস ঘটনায় মারা গেছে আটজন। গত বৃহস্পতিবার রাতে সাতক্ষীরার কলারোয়া ও সরসকাটিতে দু আওয়ামী লীগ নেতাকে তাদের বাড়ি থেকে মুখোশধারীরা তুলে নিয়ে গিয়ে জবাই করে খুন করে। গতকাল শুক্রবার সকালে কুচপুকুর গ্রামের কিশোর রিয়াজ হোসেনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ তিনটি হত্যার ঘটনায় জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে র্যাবের গুলিতে চটপটি ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। জামায়াতের দাবি তিনি তাদের কর্মী। পিরোজপুরের জিয়ানগরে বৃহস্পতিবার গভীররাতে ১৮ দলের বিক্ষোভ মিছিলে গুলিতে এক বিএনপি কর্মী নিহত হয়েছে। শুক্রবার রাতে খুলনায় নঈম নামে এক আখ বিক্রেতা গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাকে শিবিরকর্মী বলে দাবি করেছে জামায়াত-শিবির। এদিকে কাদের মোল্লার ফাঁসির খবরে জয়পুরহাটের কালাইয়ে এক জামায়াতকর্মী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যশোরে ট্রাক চাপায় এক শিবিরকর্মী নিহত হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের প্রায় ২৮ জেলায় গাড়ি ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ ও আগুন দিয়ে সহিংসতা করেছে জামায়াত শিবিরের কমী সমর্থকরা।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। পৃথক ঘটনায় সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, পিরোজপুর ও যশোরে ৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। রাজধানীতেও ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সহিংসতা ও সংঘর্ষে কয়েকশ’ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরদার তৎপরতার পরও সহিংসতা রোধ করা যায়নি। গত বৃহস্পতিবার রাতে বহুল আলোচিত এ ফাঁসির রায়
কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাসাবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, ঝটিকা মিছিল করে ঘটনার প্রতিবাদ জানায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। গতকাল দিনভর তাদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। এ সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষ হয় বিভিন্ন স্থানে। গতকাল রাজধানীতে বড় আকারের শোডাউন করে জামায়াত-শিবির। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার প্রতিবাদে গতকাল সিলেটে জালালাবাদ থানায় হামলা চালিয়েছে শিবির। এ ছাড়া শহরতলির মোগলাবাজার রেল স্টেশনে আগুন দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বিছনানদীর ওপর নির্মিত বেইলি সেতু তুলে ফেলা হয়। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলা পরিষদে আগুন দিয়েছে শিবিরকর্মীরা। এ ছাড়া রামগতি-লক্ষ্মীপুর সড়ক কেটে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। জয়পুরহাটে বাইপাস সড়ক কেটে দেয়া হয়। সীতাকুণ্ডে মহাসড়কে ব্যারিকেড দেয় শিবির কর্মীরা। ঠাকুরগাঁওয়ে ৫ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে গাছ কেটে অবরোধ করে রাখে শিবির নেতাকর্মীরা। কুড়িগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর করা হয়। যশোরের মনিরামপুরে সড়কে কয়েকশ’ গাছ কেটে অবরোধ করে রাখে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। পাবনায় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ও ৫টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। ফতুল্লায় ২০টি গাড়ি ভাঙচুর, ৪টিতে আগুন দেয়া হয়। শিবিরকর্মীরা ট্রাফিক পুলিশের ২ সদস্যকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পিটুনি দেয়। দিনাজপুরে এমপির বাড়ি ও নির্বাচন অফিসে হামলা চালানো হয়। সড়ক কেটে, ব্রিজের পাটাতন ওপড়ে ফেলে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এ অবস্থায় জেলা পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়। গাজীপুরে জয়দেবপুর রেল স্টেশনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে শিবির কর্মীরা। এতে আহত হয় ১০ জন। ঝিনাইদহে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। গাছ কেটে সড়ক অবরোধ করার সময় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায়। এতে ২০ গ্রাম বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় গতকাল ছুটির দিনেও প্রায় সারাদেশের জীবনযাত্রা অবরুদ্ধ ছিল। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ পারতপক্ষে ঘরের বাহির হয়নি।
ঝিনাইদহ অফিস জানিয়েছে, জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির পর ঝিনাইদহে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। গতকাল শুক্রবার সকালে কোটচাঁদপুর উপজেলার পাশপাতিলা এলাকায় সড়কের ওপর গাছ ফেলে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে তারা। এ সময় একটি পণ্যবাহী ট্রাক ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত অন্তত ১০ ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেয় জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। মধ্যরাতে সদর উপজেলার বৈডাঙ্গা বাজারের পাশে ৫টি ট্রাক ও একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেয় তারা। কালীগঞ্জ উপজেলার বেজপাড়া নামক স্থানেও একটি ট্রাকে আগুন দেয়া হয়। মহেশপুর উপজেলায় সামন্তা গ্রামে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মোশারফ হোসেন, আনিচুর রহমানেরসহ ৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। এ সময় হামলায় আহত হয় ৬ জন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসেরকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। শৈলকুপার শেখপাড়া বাজারে অন্তত ১৫টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী নেতা মিজানুর রহমান খাঁনের বাড়িতেও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টির জন্য গাছ কেটে ফেলার কারণে সদর উপজেলার ডাকবাংলা ও আমেরচারাবাজার এলাকাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে বিদ্যুতবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঝিনাইদহ বিদ্যুত বিভাগ জানিয়েছে, রাস্তার গাছ কেটে বৈদ্যুতিক তারের ওপর পড়ায় রাত ১১টা থেকে প্রায় ২০টি গ্রাম বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংযোগ মেরামতের কাজ করছেন।
নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি নিশ্চিত করে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন জানান, সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জেলার পুলিশ ও ছয়টি থানায় সর্বোচ্চ সর্তকাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেইসাথে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার জীবননগরে জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির প্রভাষক খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে জীবননগর পাইলট হাইস্কুল ক্যাম্পাস থেকে এ বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। জামায়াত আমির প্রভাষক খলিলুর রহমান মিছিলপূর্ব বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতির বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখেন উপজেলা সেক্রেটারি মাও. ইসরাইল হোসেন, পৌর আমির মাও. সাজেদুর রহমান, আন্দুলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন, উপজেলা সহকারী সেক্রেটারি ইব্রাহিম খলিল, পৌর সেক্রেটারি গোলাম রসুল, হাসাদহ ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, উথলী ইউনিয়ন আমির আসাবুল হক মল্লিক প্রমুখ।
মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কাদের মোল্লা ফাঁসির পরপর মহেশপুর উপজেলার সামন্তা বাজারে ও গ্রামে জামায়াত-শিবির হামলা চালিয়ে ৪টি দোকান পুড়িয়ে ৭টি বসতবাড়ি ও দুটি বাস ভাঙচুর করে লুটপাট করেছে।
জানা গেছে, কাদের মোল্লা ফাঁসির ঘটনায় উপজেলার সামন্তা গ্রামের সেলিম, রজব আলী মেম্বার মোশারেফ গুলজারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে কাথা, লেপ, তোষকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ঘরের কিছু মালামাল পুড়ে যায়। এছাড়া ওই রাতে সামন্তা বাজারে রায়হান উদ্দীন বেগের ভাইদের ৪টি দোকানঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। গতকাল শুক্রবার বিকেলে মহেশপুর কলেজমাঠে ১৮ দলের পক্ষ থেকে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বেগমপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গা সদরের তিতুদহে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিল গতকাল শুক্রবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিক্ষোভ মিছিলটি ইউনিয়নের খাড়াগোদা বাজার হয়ে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন স্লোগান দেয়। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি খাইরুল ইসলাম ও তিতুদহ ইউনিয়ন আমির রেজাউল হকের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন জামায়াত নেতা আকতার হোসেন, ছালাউদ্দিন আহম্মেদ, শরিফুল ইসলাম, আব্দুল আজিম, আব্দুস সামাদ, আনোয়ার হোসেন, আবুল কালাম প্রমুখ।