চিরকুট বিস্ময় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চিরকুট পাঠিয়ে যে অঘটন ঘটানো হয়েছে, তা এক কথায় মহাকাব্যিক। দেশের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠের গৌরব করার অনেক কিছুই বিলুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টি ভর্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যাপারে সবসময়ই আপসহীন থেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতা প্রশংসনীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগে বা বিষয়ে ভর্তি হতে আসন সংখ্যার তুলনায় প্রার্থী স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে বলে মেধাবী ও যোগ্যদের নির্বাচন করতে নেয়া হয় ভর্তি পরীক্ষা। এর বাইরে ভর্তির সুযোগ ও নজির না থাকলেও এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সে ঐতিহ্য ভঙ্গ করে সেখানে ‘চিরকুটে’র মাধ্যমে ভর্তির যে অভিযোগ উঠছে, তা আমাদের হতাশ না করে পারে না। আমাদের বিস্মিত করে যখন সেই ভর্তির পক্ষে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ‘চিরকুটে ভর্তির পক্ষে সাফাই ঢাবি প্রশাসনের’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, সেটি আমাদের বিস্ময় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নিয়মমাফিক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি না হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের ‘যথাযথ নিয়ম মেনেই শিক্ষার্থীদের সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি করা হয়েছে’ বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়টির ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণœ করেছে, তা বলা বাহুল্য। এ লজ্জা মেনে নেয়া কঠিন। যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির জন্য ছাত্রত্ব বাতিল করে, সেই প্রশাসনের এ কী রূপ আমরা দেখছি! কীভাবে পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আট নেতা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ৮জনসহ ক্ষমতাসীন সংগঠন ছাত্রলীগের ৩৪ নেতা ডাকসু নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে কেবল ছাত্রত্ব প্রমাণের জন্য প্রশাসনের সহায়তায় পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তির যে বিষয় ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ক্ষতি। এর মাধ্যমে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি; বরং ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সংগঠনটির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ বাকি ছাত্র সংগঠনের রয়েছে, সেটি আরও জোরদার হলো। কয়েক দিন ধরে এ অনিয়মের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। বিষয়টি গুরুতর ও স্পর্শকাতর।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। লিখিত পরীক্ষা ছাড়া সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তির সুযোগ রয়েছে বলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অন্য শিক্ষকদেরও বিস্মিত করেছে। আমাদের অজানা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরণের খোদ সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়েই রয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ রয়েছে, ডাকসুর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রথমে কেবল নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই ছিলো যোগ্য, পরে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। এখন এই ভর্তি কেলেঙ্কারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া বহুল প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচনও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায় বর্তায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই। খোদ উপাচার্যও দায় এড়াতে পারেন না। একজন ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম না মেনে, দায় এড়াতে তার মর্জিমাফিক বক্তব্য দেন কীভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন বক্তব্য মেনে নেয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থান পরিস্কার করে ঘোষণা করুক- সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং ব্যক্তির বক্তব্য এবং এ পুরো ঘটনায় একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে, পুরো বিষয় খতিয়ে অভিযুক্ত অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। এ ক্ষেত্রে অপরাধী যে-ই হোক, তাকে ছাড় দেয়া যাবে না। ব্যক্তির চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বড়। আর ব্যক্তির পাঠানো চিরকুট তো সেখানে তুচ্ছ। ফুঁ দিলেই উড়ে যাওয়ার কথা!