ক্রীড়া প্রতিবেদক: তাসকিন আহমেদ যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন মোটেও ভেঙে পড়েননি, কতক্ষণ আর লুকিয়ে রাখা যায় মনের কথা! একটা সময়ে সরল স্বীকারোক্তি, ‘মন খারাপ তো হয়ই’। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিসিবি একাডেমি ভবনে এলেন স্ত্রী সৈয়দা রাবেয়াকে নিয়ে। মনটা হালকা করতে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন, তা নয়। স্ত্রীর জরুরি একটা কাজ ছিল আগারগাঁওয়ে। কাজ শেষে তাসকিনের সঙ্গে রাবেয়া ঘুরে গেলেন বিসিবিতেও।
এমন দিনই ক্রিকেটপাড়ায় এলেন রাবেয়া, আগের দিন তাসকিন পেয়েছেন বড় দুঃসংবাদ। বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়েছেন। ছন্দে নেই, জাতীয় দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন—অনেক দিন ধরেই হতাশার মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে তাসকিনের মাথার ওপর। সেটি আরও কৃষ্ণরূপ পেয়েছে গত কিছুদিনে। তবে তাসকিন অনুপ্রেরণা খুঁজে নিচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজার কথায়। বাংলাদেশ ওয়ানডে অধিনায়ক বলেছেন, বাদ পড়া ক্রিকেটারদের ফিরে আসতে যত সহযোগিতা করা দরকার, সেটি তাঁরা করবেন।
তাসকিন অনুপ্রাণিত হচ্ছেন মাশরাফির কথায়, ‘সিনিয়র খেলোয়াড়েরা অভিভাবকের মতো। তাঁরা সব সময়ই আমাদের পাশে থাকেন। উৎসাহ দেন। জীবনে ভালো-খারাপ সময় আসে। সব সময়ই বলে আসছি, ফিরে আসাটা সময়ের ব্যাপার। মাশরাফি ভাইদেরও উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। তবে তার আগে আমার পিঠের চোটটা সারিয়ে তুলতে হবে।’
এই চোট অনেক দিন ধরে ভোগাচ্ছে তাসকিনকে। শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফি খেলেছেন চোট নিয়েই। ব্যথানাশক ওষুধ আর ইনজেকশন নিয়ে খেলেছেন ম্যাচ। ছন্দে নেই বলে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। কিন্তু তাতে ক্ষতিটা আরও বেশি হয়েছে। চোট নিয়ে বলতে গিয়ে কাতর কণ্ঠ তাসকিনের, ‘ চোট নিয়ে খেলে শরীর আরও খারাপ হয়েছে, খেলাও খারাপ হয়েছে। মানুষের গালিও খেয়েছি! শতভাগ ফিট না হয়ে কোনো ধরনের ক্রিকেটই খেলতে চাই না। এখন আমার প্রথম কাজ পুরোপুরি চোটমুক্ত হওয়া।’
সৌম্য সরকার এই মুহূর্তে সাতক্ষীরায়। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মেজো ভাই পুষ্পেন সরকারের বিয়ে। পারিবারিক এই উৎসবের মধ্যেই পেয়েছেন দুঃসংবাদ। মন খারাপের দিনেও সৌম্যকে তাই হাসিমুখে থাকতে হচ্ছে। এ যেন ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে ধেয়ে আসা বাউন্সারে বাউন্ডারি হাঁকানোর শর্ত! চুক্তি থেকে বাদ পড়ার কথা বলতেই সৌম্যর আপত্তি, ‘আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, মনে করিয়ে দিলেন!’
চাইলেই তো আর বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। সৌম্যও বাস্তবতা মেনে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে ফিরে আসার চ্যালেঞ্জটাও নিচ্ছেন, ‘ভালো কিছু করতে পারিনি বলেই চুক্তিতে নেই। এমনভাবে ফিরতে চাই যাতে জাতীয় দলে জায়গাটা আর নড়বড়ে না হয়। ঘরোয়া ক্রিকেট কিছু রান করে ফিরলাম এমন নয়। এমনভাবে ফিরতে চাই যেন জাতীয় দলে ধারাবাহিক ভালো খেলতে পারি। এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। আমার কাজ ভালো খেলা। সেটাতেই মনোযোগ রাখতে চাই।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) খেলতে মোসাদ্দেক হোসেন এখন রাজশাহীতে। পারফরম্যান্সের নিরিখে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, মোসাদ্দেক বলতেই পারেন, ‘চোটে পড়ে খেলারই সুযোগ পাইনি, পারফর্ম করব কীভাবে!’ ২০১৭ সালে মার্চে কলম্বোয় শততম টেস্টে অসাধারণ ব্যাটিং, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে দুর্দান্ত বোলিংয়ে দলকে ম্যাচে ফেরানো মোসাদ্দেক হঠাৎ দৃশ্যপট থেকে আড়াল হয়ে গেলেন চোখের সংক্রমণে পড়ে। ছন্দে ফিরতে তাঁকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়েছে কি না প্রশ্নটা তোলাই যায়।
চুক্তি থেকে বাদ পড়ে হতাশ হলেও মোসাদ্দেক ভেঙে পড়ছেন না, ফিরে আসার প্রত্যয় তাঁর কথায়, ‘আমি খেলার মধ্যে ছিলাম না দীর্ঘদিন। চোটে কারও হাত নেই। এটার কারণে ছন্দে নেই, সেটি কিন্তু নয়। চোট থেকে ফিরে বিপিএলে ঠিকমতো ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাইনি। আমার ব্যাটিং অর্ডার হঠাৎ ওলটপালট হওয়ায় একটু সমস্যাও হয়েছে। ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আশা করি ধীরে ধীরে ছন্দ ফিরে পাব।’
চুক্তি থেকে বাদ পড়া নিয়ে একেবারেই ভাবছেন না ‘টেস্ট বোলার’ তকমা পাওয়া কামরুল ইসলাম। তাঁর ভাবনায় শুধুই ভালো খেলা, ‘ক্রিকেট যখন কেউ খেলা শুরু করে তখন কেউ টাকার কথা ভেবে খেলে না। পরে খেলতে খেলতে টাকা, বেতন, চুক্তি এসব আসে। কীভাবে আবার চুক্তিতে ফিরব সেটা নিয়ে চিন্তিত নই। চিন্তাটা হচ্ছে আমার খেলা নিয়ে। চুক্তিকে তারা রাখবে কী রাখবে না, এটা বোর্ডের ব্যাপার। আমার ভাবনা শুধুই পারফরম্যান্স নিয়ে।’
বিসিবির চুক্তিতে আসা বা বাদ পড়া ইমরুল কায়েসের কাছে নতুন নয়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে চুক্তির বাইরে ছিলেন। ফিরেছিলেন ২০১৪ সালে। চার বছর পর আবারও বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা হলো বাঁহাতি ওপেনারের। ক্যারিয়ারে এত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছেন, এসব আর স্পর্শ করে না ইমরুলের, ‘এসব সয়ে গেছে। খারাপ সময় যাচ্ছে বলে ভালো সময় আসবে না, তা নয়। এসব নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন নই। জাতীয় দলে খেলাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিসিবির সঙ্গে চুক্তি থাকলে আগ্রহ-তাড়না একটু বেশি থাকে। মনোযোগ আরও বেশি থাকে। কোথাও চুক্তিবদ্ধ থাকলে আপনার মধ্যে এমনি তাদের হয়ে ভালো কিছু করার তাড়না থাকে।’
চুক্তিতে থাকলে আর্থিকসহ বিসিবির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অনায়াসে মেলে। তবে না থাকা মানে এই নয় যে জাতীয় দলের দরজা বন্ধ। আন্তর্জাতিক মঞ্চটা সব খেলোয়াড়ের জন্যই উন্মুক্ত। তবে এ মঞ্চে ওঠার একটাই শর্ত, ধারাবাহিক ভালো খেলতে। তাসকিন-সৌম্য-সাব্বিররা ইতিবাচক দিক খুঁজে নিতে পারেন এখানেই, এ শর্ত তো সব ক্রিকেটারেরই।