স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের সামনে এখন তিন বিকল্প। কোনটি বেছে নেবে সে? জাতিসংঘের দূত অস্কার ফার্নানদেজ-তারানকোর দূতিয়ালির রাজধানী এক্সপ্রেস গতরাতেও পৌঁছায়নি স্টেশনে। সিইসি’র সাথে শেষ দফা বৈঠকের পরে চারটি ‘যদি’র ওপর বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্য নির্দেশ করেছেন তিনি- এক. রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দুই. নেতৃত্ব। তিন. ছাড় দেয়ার মানসিকতা। চার. শান্তিপূর্ণ সংলাপ।
তিন দিনে ২০টির বেশি বৈঠকে টানা আলোচনার পর প্রধান দু রাজনৈতিক দলকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সংলাপে বসার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করে সমঝোতায় পৌঁছুনোর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন তিনি। তারানকোর উপস্থিতিতে অওয়ামী লীগ আলোচনা শুরু করারও প্রস্তাব ছিলো দলটির। তবে তারা শেখ হাসিনাকেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাখার অবস্থানে অনড় আছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। এর বাইরে আলোচনা হলে তারা অংশ নেবে। আলোচনায় যুক্ত দু দলের নেতাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তারানকো বলেন, ‘চলমান অচলাবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকলে, তাদের মাঝে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনায় বসার আগ্রহ থাকলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
দু দলের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, তারানকো সংবিধানের আওতার মধ্যেই সঙ্কট নিরসনে দু দলকে আলোচনায় বসার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি দু পক্ষে আলোচনা শুরুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনকে কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনার কথা বলেন। গতকাল বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভীর গুলশানের বাসভবনে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথেও দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন তারানকো। ঘণ্টাব্যাপি বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দেন। তারা সংসদ ভেঙে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরেন। তারানকো সংবিধানের মধ্যে নির্বাচনের যুক্তি সমর্থন করলেও দু দলের সমান সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করেন। তিনি এ বিষয়ে দু দলের মধ্যে সংলাপের প্রস্তাব দেন।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সাথে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, গওহর রিজভী, মাহবুব উল আলম হানিফ ও ফারুক খান।
বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান না রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তারানকোকে বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, তারানকো বিএনপিকে জানিয়েছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে সমাধান করার কোনো পন্থা থাকলে তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বলে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারানকো নির্বাচনের সময় জাতিসংঘের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও ‘স্বল্প-ক্ষমতার’ প্রধানমন্ত্রীর কথা বলেন। নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকলে সমঝোতা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনাকে সরে যেতে হবে বলে তারানকোকে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
গতকাল সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার সাথে তারানকোর দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির দুজন নেতা বলেন, তারানকোর সফরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে-এখন পর্যন্ত এটা বলা যাবে না। তারা মনে করছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তারানকোর এ সফরে সমাধান আসবে না। তবে বিএনপি তারানকোকে আশ্বস্ত করেছে, তারা আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তারানকো প্রস্তাব তুললে খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা যায় না। তার ক্ষমতা সংবিধানে দেয়া আছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব কখনো কমানো সম্ভব না। তাই যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, তাকে অ-গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষমতাহীন করা বাস্তবসম্মত নয়।
বৈঠক শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আমাদের বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। আলোচনা অব্যাহত আছে। এ মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।’ এর আগে দুপুরে গুলশানে শমসের মবিনের সাথে তারানকোর একান্তে বৈঠক হয়।
তবু আশাবাদ: এ অবস্থায়ও চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান নিয়ে আশাবাদী জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব তারানকো। নির্বাচন কমিশনে সিইসির সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে তিনি গতকাল দুপুরে মুখ খোলেন। তিনি আশাবাদের কথা জানালেও সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি। সিইসি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখনো চলছে। দেখা যাক কী হয়। এ নিয়ে এখন আর কোনো মন্তব্য করবো না।’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগের আলোচনার তুলনায় গতকালের আলোচনাটি ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত। নির্বাচনের তফশিল নিয়ে সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের মতগুলো সিইসির কাছে তুলে ধরেন তারানকো। এ সময় সিইসি জানান, এসব মতের সাথে তিনিও একমত। একমাত্র প্রধান দু রাজনৈতিক দলের মাঝে সমঝোতা হলেই তফশিল পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু সমঝোতা না হলে আগেভাগেই আইনের বাইরে গিয়ে ইসি তফশিলে কোনো পরিবর্তন আনার পক্ষপাতী নয়।