স্টাফ রিপোর্টার: সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে সরকারি দল ও বিরোধীদলকে সমঝোতায় পৌঁছাতে প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন সফররত জাতিসংঘের বিশেষ দূত। জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো গতকাল রোববার সফরের দ্বিতীয় দিনেও বিভিন্ন মহলের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেন। নির্বাচন নিয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে তিনি চেষ্টায় কমতি রাখছেন না। অথচ সরকারি দল ও বিরোধীদল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ও সমঝোতা না হলে ৫ জানুয়ারি ঘোষিত নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে। সুশীল সমাজ ও কূটনীতিক মহল এখনও সমঝোতার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে।
সঙ্কট উত্তরণে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের পদ থেকে সরে গিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে দায়িত্ব প্রদান এবং তার অধীনে অথবা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নানদেজ-তারানকো প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে বৈঠকে তার মাধ্যমে পাঠানো জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রস্তাব তুলে ধরেন। সরকার ও বিরোধীদলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত ও রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ঢাকা মিশনে কি হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই অজানা। সঙ্কট নিরসনে দু নেত্রীর সাথে একান্ত বৈঠকে তারানকো কি পরামর্শ দিয়েছেন, জাতিসংঘ কি করতে চায় সে সম্পর্কে একটি শব্দও এখনও জানা যায়নি। শনিবার খালেদা জিয়ার সাথে একান্ত বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকেও বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে। বৈঠক শেষে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরী জানিয়েছেন, কৌশলগত কারণে এখন কোনো কিছু বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও তারানকোর প্রায় এক ঘণ্টার একান্ত বৈঠক সম্পর্কে কোনো কিছুই জানানো হয়নি। সংশ্লিষ্টরাও এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চাইছেন না। আজ সন্ধ্যায় আবারো বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সাথে তার বাসভবনে এবং আগামীকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করবেন তারানকো। দু নেত্রীর সাথে দ্বিতীয়বারের এ বৈঠকেই সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘের উদ্যোগ চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে।
নির্বাচনী সঙ্কট নিরসনে এবারের কৌশল সম্পর্কে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে যাতে কোনো তথ্য পাচার না হয়, সেজন্য জাতিসংঘের ঢাকাস্থ মিশনের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে তারানকোর তৎপরতার বাইরে রাখা হয়েছে। তারানকোর সফরসূচির অনেক ক্ষেত্রে খালি রাখা হয়েছে। এ খালি সময়ে কার কার সাথে বৈঠকের কথা রয়েছে সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব খালি সময়সূচিতে পরিস্থিতি অনুযায়ী তাৎক্ষণিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যেমনটি রোববার প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সাথে অনির্ধারিত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ড. গওহর রিজভীর সাথে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের আলোচনার বিষয়ও গোপন রাখা হয়। রোববার সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরীর সাথেও অনির্ধারিত বৈঠক করেন তারানকো।
দু নেত্রীর সাথে তারানকোর একান্ত বৈঠক সম্পর্কে কূটনীতিকরা জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত একবার নয়, তিনবার ঢাকা সফরের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ কোনো দেশের সাধারণ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ এতোবার বিশেষ দূত পাঠায় না। কাজেই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই হবে। সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী তারা যেসব পরামর্শ দিতে পারে তা দু নেত্রীকে একান্ত বৈঠকে দিয়ে গেছেন বিশেষ দূত তারানকো। সঙ্কট নিরসন না হলে এবং সংঘাত ও সহিংসতা চলতে থাকলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে করণীয় সম্পর্কেও দু নেত্রীকে অবহিত করেছেন তারানকো। এছাড়া একান্ত বৈঠকে সঙ্কট নিরসনে কে কতোটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছেন এ বিষয়েও তারানকোকে দু নেত্রী জানিয়েছেন। দ্বিতীয়বার বৈঠকে এ ছাড় দেয়া নিয়ে এবং সে অনুযায়ী সঙ্কট সমাধানে ফের দু নেত্রীর সাথে বৈঠক করবেন তারানকো। গোপন বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কট নিয়ে দু নেত্রীর অবস্থান সম্পর্কে মহাসচিব বান কি মুনের কাছে আলাদা রিপোর্ট করবেন তারানকো। তারানকোর এ রিপোর্টের ভিত্তিতেই জাতিসংঘ তার করণীয় নির্ধারণ করবে। এ রিপোর্টে প্রতিফলিত হবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে। জাতিসংঘও সে অনুযায়ী করণীয় নির্ধারণ করবে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘের কোনো ফর্মুলা দেয়ার এখতিয়ার নেই। আর জাতিসংঘ সে চেষ্টাও করবে না বলে জানান কূটনীতিকরা। তবে সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন, সেই সমঝোতার চেষ্টা করছেন তারানকো। এজন্য জাতিসংঘের একজন মধ্যস্থতা বিশেষজ্ঞও প্রতিনিধি দলে এসেছেন।
বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনে তারানকো গতকাল নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সকালে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সাথে, পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীনের সাথে বৈঠক করেন। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সাথে অনির্ধারিত বৈঠক করেন তারানকো। বিকেলে সুশীল সমাজের সাথে মতবিনিময় করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ড. কামাল হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। বৈঠক শেষে ড. কামাল হোসেন জানান, বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘ কোনো ফর্মুলা দেবে না। তবে জাতিসংঘ চায় সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। একতরফা নির্বাচন কেউই চায় না। জাতিসংঘও চায় না। এজন্য একতরফা নির্বাচনের ট্রেন থামা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এখনও সময় আছে। নির্বাচনী তফশিল পিছিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ হওয়ার পর পুনঃতফশিল করা যাবে কী না তা নিয়ে কমিশনের দুটি মত পাওয়া গেছে। একটি মত হচ্ছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত জেনারেল ক্লজেস অব অ্যাক্ট অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ইচ্ছেমতো তফশিল পরিবর্তন করতে পারবে। অপর মত হচ্ছে, নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় শেষ হওয়ার আগে পুনঃতফশিলের সুযোগ ছিলো। মনোনয়নপত্র দাখিল ও যাচাই-বাছাই করে বৈধ প্রার্থীদের নামের তালিকা প্রকাশের পর সে সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পুনঃতফশিল বিষয়ে নির্বাচনী শাখা ও আইন শাখা থেকে এ দুটি মত পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে পুনঃতফশিলের সুযোগ রয়েছে। সবাই রাজি থাকলে পুনঃতফশিল হলে কোনো আইনি জটিলতা দেখা দেবে না। সবাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়। একই বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কাছে জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো জানতে চেয়েছেন। জবাবে সিইসি বলেছেন, সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে অনেক কিছু সম্ভব। তবে তা আইনি কাঠামোর মধ্যে থাকতে হবে। গত ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন ছিলো ২ ডিসেম্বর। গত ৫ ও ৬ ডিসেম্বর প্রার্থিতা যাচাই-বাছাই শেষে বৈধ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। আগামী ১৩ ডিসেম্বর প্রত্যাহারের শেষ দিন। ৫ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ অবস্থায় বিএনপিসহ বিরোধী জোট এ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় পুনঃতফশিলের বিষয়টি আলোচনায় উঠেছে।
কমিশনের একটি অংশের মতে, সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর কোনো বিধানেই ঘোষিত তফশিল পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। ইতোমধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩৩টি আসনে নির্বাচন প্রায়শ সম্পন্ন হয়েছে। ওই ৩৩টি আসনে সরকারদলীয় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের তফশিল আর পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।
তবে আইন শাখার অভিমত, কোনো প্রার্থী বৈধ এবং কে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন তা কমিশনের কাছে বিবেচ্য নয়। নির্বাচনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও গেজেট জারি ছাড়া নির্বাচন শেষ হয়েছে তা বলার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচনের তফশিল পরিবর্তন করা যায়। কয়েকটি নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের একদিন আগে অর্থাৎ ওই বছরের ২১ জানুয়ারি জেনারেল ক্লজেস অব অ্যাক্ট প্রয়োগ করে ওই নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিলো। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনবার পুনঃতফশিল ও একবার ভোটগ্রহণের সময় পরিবর্তন করা হয়েছিল। ওই পুনঃতফশিল নিয়ে পরবর্তীতে আদালতে কোনো চ্যালেঞ্জ হয়নি।