স্টাফ রিপোর্টার: পূর্ববঙ্গে সংঘটিত ভাষাআন্দোলনকে এদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অবশ্য তেভাগাসহ বামপন্থি আন্দোলনগুলোকে বিবেচনায় না এনে। ভাষা আন্দোলনের সর্বোচ্চ প্রকাশ বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে যা ‘একুশে’ নামে সর্বজনে পরিচিত। একুশের আন্দোলন দেশের সর্বস্তরের মানুষকে কমবেশি স্পর্শ করেছিলো, উদ্দীপ্ত করেছিলো। সূচনালগ্নে এ আন্দোলনের প্রধান কারিগর রাজনীতিমনস্ক ছাত্রসমাজ, পরে রাজনীতিকসহ শিক্ষিত শ্রেণির বড়সড় অংশ ও জনসাধারণ। সেইসঙ্গে দেখা গেছে শ্রমজীবী শ্রেণির সমর্থন এবং তাদের অনেকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, মিছিল থেকে মিছিলে। এসব কারণে দ্রুতই ছাত্র-আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। তবু মনে রাখতে হবে এ আন্দোলন মূলত শিক্ষায়তনগুলোকে কেন্দ্র করে সূচিত, তাই এর বিস্তার দূর গ্রামের স্কুল পর্যন্ত।
প্রদেশব্যাপী বিস্তৃত এ আন্দোলনের বিশদ ইতিহাস তুলে ধরার পরিবর্তে সময়সীমার কারণে এ নিবন্ধের মুখ্য আলোচ্য বিষয় এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, তাত্পর্য, তাত্ত্বিক চরিত্রসহ বাঁকফেরানো ঘটনার সূত্রে আন্দোলনের বিচার-বিশ্লেষণ। এছাড়া একুশের চেতনা বলতে আমরা কী বুঝি তারও বিচার-ব্যাখ্যা এ আলোচনার অন্তর্গত। তবু ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট হিসেবে কিছু তথ্যসূত্র উল্লেখ করতেই হচ্ছে এবং তা আন্দোলনের তাত্পর্য ও উত্স বুঝতে অপরিহার্য।
প্রসঙ্গত রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে প্রতিবাদী রচনা এবং বিক্ষোভ ও আন্দোলন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ অপ্রিয় সত্য উল্লেখ করতেই হয় যে শীর্ষস্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির স্বার্থভিত্তিক মন্তব্য, বক্তব্য-বিবৃতি ও পদক্ষেপ বারবার বাঙালি ছাত্রদের প্রতিবাদী তত্পরতা উসকে দিয়েছে, আন্দোলন সংঘটনে সাহায্য করেছে। তা না হলে এ আন্দোলন কখন কিভাবে দেখা দিতো বলা কঠিন।
যেমন ১৭ মে (১৯৪৭) এক সম্মেলনে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান বলেন, যে পাকিস্তান হতে যাচ্ছে তার রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এ বক্তব্যের প্রতিবাদে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রবন্ধ লেখেন কয়েকজন লেখক-সাংবাদিক-কবি ইত্তেহাদ ও আজাদ পত্রিকায় জুন-জুলাই (১৯৪৭) মাসে। সাপ্তাহিক মিল্লাত লেখে বলিষ্ঠ সম্পাদকীয় মন্তব্য। শুরুটা এভাবে যা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্ব। এর ধারাবাহিকতায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উর্দুর পক্ষে বিবৃতির বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখেন পণ্ডিতপ্রবর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
একাধিক জনের রচনায় এ তাত্ত্বিক ধারা চলেছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭-এর পুরো বছরটিতে। এর সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটেছে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের তত্পরতায়। সঙ্গে দু’একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ছাত্র ফেডারেশন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পর সংগঠিত প্রথম আন্দোলন ১৯৪৮’র মার্চে। স্বতঃস্ফূর্ত সূচনায় অগ্রণী ভূমিকায় ছাত্রসমাজ। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত পরিষদে বাংলার ব্যবহারিক ভূমিকা বিষয়ক প্রস্তাব তাত্ক্ষণিক নাকচ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে ঢাকাসহ প্রদেশের বিভিন্ন শহরে ভাষা আন্দোলন। কিন্তু আন্দোলন স্থগিত করা হয় জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফর নিরুপদ্রব করতে। উল্লেখ্য যে, এ সময় কলকাতায় বামপন্থিদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এশীয় যুব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিগণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেন।