মো. শাহাবুদ্দিন: স্বামী মারা যাওয়ার পর অল্পবয়সী বেবী চিন্তা করেছিলেন আবার বিয়ে করার কিন্তু দু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি তার পুনরায় বিয়ে করে সংসার করা। তাই সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য বেছে নেন সংগ্রামী জীবন। কষ্ট করে গড়ে তোলেন পোল্ট্রি খামার। আর আজ সে পোল্ট্রি খামারই তাকে দিয়েছে সম্মানের সাথে মাথা উচু করে বাঁচার প্রেরণা। একদিকে যেমন হয়েছেন স্বাবলম্বী তেমনি দু মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য দিচ্ছেন নিশ্চয়তা। দামুড়হুদা উপজেলা শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে হাউলী ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রাম। গ্রামের ডাক্তারপাড়ার খাজা গিয়াস উদ্দিনের একমাত্র কন্যা লাইলী আক্তার বেবী। এসএসসির গন্ডি পার হতে না হতেই বাবা সখ করে বিয়ে দেন একই গ্রামের মৃত আফজাল মেম্বারের ছেলে আলতাফ হোসেনের সাথে। বিয়ের এক বছরের মাথায় তার কোল আলো করে জন্ম নেয় তার বড় সন্তান আফসানা আজমী কুমকুম। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিলো বেবীর দিন। কয়েক বছরের ব্যবধানে বেবীর কোল জুড়ে আসে তার ছোট মেয়ে আরোষা আজমী কুশমী। দু মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসারে হঠাৎ করেই যেন বিষাদের কালো মেঘ নেমে আসে। সংসার জীবনের ১০ বছরের মাথায় হঠাৎ করেই বিধবার বেশে সাজতে হলো তাকে স্বামীর আকষ্মিক মৃত্যুতে। শোকে বিহ্বল বেবী হয়ে পড়লেন অসহায়। অবস্থা আরো করুণ হয়ে পড়লো যখন শ্বশুরবাড়ির লোকজনও তার থেকে দূরে সরে যেতে থাকলো। বাধ্য হয়ে বেবী তার দু সন্তানকে সাথে নিয়ে ফিরে আসেন পিতার ভিটেয়। অনিশ্চিত জীবনের কথা চিন্তা করতে করতে দিনাতিপাত করতে থাকেন তিনি দু মেয়েকে সাথে নিয়ে। ভাবতে থাকলেন কী হবে তার, কীভাবে মানুষ করে গড়ে তুলবেন তার সন্তানদের কে যোগাবে তাদের লেখাপড়ার খরচ। পরিবারের লোকজন তাকে আবার বিয়ের কথা বলতে থাকে। কিন্তু দু মেয়ের মুখের পানে চেয়ে তিনি আর রাজি হন না সংসার করতে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য আর সন্তানদের নিশ্চিত ভবিষ্যত তৈরির আশায় তিনি বেছে নিলেন সংগ্রামী জীবন। স্বামীর রেখে যাওয়া ডিপিএস’র টাকা ও নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে বহু কষ্টে গড়ে তুললেন মাত্র ৫শ মুরগির একটি ছোট্ট খামার। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এভাবেই অল্প অল্প করে মুরগি তুলে বিক্রি করতে থাকলেন। লাভের মুখ দেখতে পেয়ে সঞ্চিত করলেন সাহস। সে সাহসেই আরো কিছু মূলধন জোগাড় করে আর মুরগি বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে তৈরি করলেন ২ হাজার মুরগি রাখার একটি বড় শেড। সে শেডে প্রথমবারের মত একবারে ২ হাজার মুরগির বাচ্চা তুলে পালতে থাকলেন। তারপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এ সম্পর্কে বেবীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি কৃষি ব্যাংক থেকে ৩ লাখ টাকার প্রকল্প ঋণ নিয়ে এ নতুন শেডটি করেন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরো শেড বাড়ান। তবে এজন্য বাইরে থেকে বা ব্যাংক থেকে আর কোনো ঋণ তিনি নেননি। মুরগি বিক্রির লাভের টাকা ও পিতার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে বর্তমানে তিনি বড় ২টি শেড করে এ ব্যবসা চালাচ্ছেন। কৃষি ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন তা প্রায় পরিশোধের পর্যায়ে। বর্তমানে তার এ খামারে ২জন মহিলা শ্রমিক মাসিক ৪ হাজার টাকা চুক্তিতে রাখা হয়েছে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার জন্য। এ দু শ্রমিকের সাথে সার্বক্ষণিক কাজ করেন তিনি। দু মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে কুমকুম বর্তমানে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ২য় বর্ষের ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে কুশমী চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। তাদের লেখাপড়ার জন্য তাকে প্রতি মাসে ব্যয় করতে হয় প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা। আর এ সবই চলছে তার এ পোল্ট্রি খামারের আয় থেকে। ইচ্ছা করলে যে সবই সম্ভব তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বেবি। অথচ তাকে এ প্রতিষ্ঠা পেতে সহ্য করতে হয়েছে নানা বঞ্চনা, গঞ্জনা। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজ ব্যবস্থায় একটি নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যে কতো সংগ্রাম করতে হয় তা তিনি বলতে ভুললেন না কথা বলতে গিয়ে। ২০০৬ সালে মহিলা সংরক্ষিত আসনে হাউলী ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। সেখানেও তাকে নানা প্রতিকুলতার সম্মুখিন হতে হয়েছে। কিন্তু দৃঢ় মনোবল তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।