রোহিঙ্গাদের পাশে সাধারণ মানুষ

স্টাফ রিপোর্টার: শুক্রবার বেলা ১২টা। উখিয়া টেকনাফ সড়কের দুপাশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। সড়কে বাস, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাসের দীর্ঘ সারি। অধিকাংশ ত্রাণবোঝাই। অল্প কিছু যান যাত্রীবোঝাই। ত্রাণের মধ্যে আছে তৈরি খাবার, চাল, ডাল, চিড়া, মুড়ি, খাবার স্যালাইন, পানি, জামাকাপড়, কম্বল, ত্রিপল ইত্যাদি। রাস্তায় যেতে যেতে শরণার্থীদের আকুতি দেখে কেউ কেউ থেমে যাচ্ছেন। বিলিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। কেউ আবার চলে যাচ্ছেন দুর্গম এলাকাগুলোতে। যাদের আকুতি হয়তো আরো বেশি।

বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা। হাজারের বেশি রোহিঙ্গা টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপের ঘাটে। টেকনাফে প্রবেশ করতে নৌকার অপেক্ষায় তারা। এক বাণ্ডেল খুচরা টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্থানীয় হাফেজ রশিদ আহমদ। দূর থেকে দেখে দালাল ভেবে কাছে যেতেই পাল্টে গেলো ধারণা। প্রতিটি নৌকায় রোহিঙ্গাদের তুলে দিয়ে নৌকা চালককে দিয়ে দিচ্ছেন ভাড়া। আবার অপরপ্রান্তে তার লোকজন এক বোতল পানি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের।

বুধবার দুপুরের পর আকাশে তপ্ত রোদ। বালুখালীর রাস্তায় আইসক্রিম বিক্রি করছিলো জসিম উদ্দিন। সেখানে জনা ত্রিশেক শিশু ঘিরে রেখেছে আইসক্রিমের পাত্রকে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে সৈয়দুর রহমান নামের এক যুবক। এক এক করে ৫০ জনেরও বেশি শিশুকে আইসক্রিম কিনে দিলেন ওই যুবক। আইসক্রিম হাতে পেয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের মুখে তৃপ্তির হাসি। রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা এসব তরুণ, যুবক কিংবা মধ্যবয়সীদের সবাই বাংলাদেশি। রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ আহাজারি শুনে দেখে এগিয়ে এসেছেন তারা। যার যতোটুকু সামর্থ্য আছে তার সবটুকুই উজাড় করে দিচ্ছেন উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের জন্য। কেউ খাবার, পানি, স্যালাইন, কেউ আবার নগদ টাকা, কেউবা জামাকাপড় দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

বিশ্বের নানা দেশে শরণার্থীদের সাহায্যে সরকার এগিয়ে এলেও সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসার হার খুবই কম। কেবল বাংলাদেশেই দলমত নির্বিশেষে নানা শ্রেণির পেশার মানুষ দলে দলে রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। ভূপেন হাজারিকার গাওয়া ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’র কথাগুলোকে শতভাগ সত্য করে চলেছে বাংলাদেশের মানুষ। এ যেন মানবিকতার অনন্য নজির। এ গৌরব বাঙালির। এ অহংকার বাংলাদেশের।

স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান তিনি তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুই দফায় তিন হাজারের বেশি মানুষকে থামি ও লুঙ্গি প্রদান করেছেন। তিনি বলছিলেন, এখানে কোনো ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক বিষয় নেই। মানুষের বিপদে মানুষ পাশে না দাঁড়ালে কে দাঁড়াবে বলুন। রোহিঙ্গাদের এমন মানবেতর অবস্থায় রেখে আমরা চেয়ে থাকতে পারি না। আমরা সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করছি।

মোহাম্মদ সারোয়ার আলম শিল্পপতি। তিনি মোস্তফা হাকিম ফাউন্ডেশনের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। তিনি জানান, এই পর্যন্ত দুই দফায় তারা ত্রাণ বিতরণ শেষ করেছেন। এরমধ্যে প্রথমবার তিন হাজার শরণার্থীকে দুটি করে প্যাকেট দিয়েছেন। এর একটিতে ছিলো চাল, ডাল, তেলসহ খাবার সামগ্রী, অন্যটিতে ছিলো প্লেট, পাতিল ইত্যাদি ব্যবহার্য সামগ্রী। দ্বিতীয় বার চার হাজার লিটার পানি বিতরণ করেছেন। আজ শনিবার তারা পাঁচশ পরিবারকে ঘর বাঁধার জন্য তাঁবু, বাঁশ ও ব্যবহারের জন্য কম্বল, বালিশ প্রদান করবেন। এ সপ্তাহের মধ্যেই তারা একটি লঙ্গরখানা খুলবেন। যেটিতে প্রতিদিন তিন হাজার মানুষকে খাওয়ানো হবে।

মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন উপজেলা পর্যায়ের একজন মানবাধিকার কর্মী। তিনি তার দলকে নিয়ে দুই দফায় সাড়ে ছয়লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছেন। ত্রাণের মধ্যে ছিলো- গুড়, চিড়া, মোমবাতি, ত্রিপল ইত্যাদি। অনেককে আবার নগদ টাকাও দিয়েছেন। শাকিল মোস্তফা এসেছেন পাবনা থেকে। তিনি জানাচ্ছিলেন, তারা পাঁচ বন্ধু তিন দিন ধরে উখিয়ায় আছেন। তিনি এখনো পড়াশোনায় আছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের এমন দুর্দশায় তিনি থেমে থাকতে পারেননি। বন্ধুরা মিলে একটি ফেসবুক ইভেন্ট খুলে চলে যান উখিয়ায়। এরপর ফেসবুকে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ত্রাণ সংগ্রহ করে তিনি রোহিঙ্গাদের পৌঁছে দিচ্ছেন।

সৌহার্দ ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জুনায়েদ মোহাম্মদ জানান, আমাদের ফা্উন্ডেশনের ফাউন্ডার মেম্বার ডাক্তার সৈয়দ রাজিন তার মেডিকেল টিম নিয়ে টেকনাফের উড়িয়াতে অবস্থান করছেন বিনাামুল্যে ঔষধ ও চিকিৎসা প্রদানের জন্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, এনজিও সংস্থার বাইরে এমন মুজিব, সারোয়ার, নিজাম, শাকিলের মতো প্রতিদিন শ শ ব্যক্তি, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গাদের জন্য। তারা বাস, মাইক্রো রিজার্ভ করে ত্রাণ বিতরণ করতে আসছেন। এদের মধ্যে অনেকেই কক্সবাজার জেলা প্রশাসনে ত্রাণ জমা দিচ্ছেন। কেউ কেউ প্রশাসন থেকে তালিকা নিয়ে প্রশাসনের নির্দিষ্ট করে দেয়া শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ দিচ্ছেন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজ উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করায় কি পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে তার সঠিক হিসেব কারো কাছে নেই। আবার ব্যক্তিগত ত্রাণ বিতরণে আইনি বাধা থাকলেও প্রশাসন বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখছে বলেই মনে হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এডিসি মাহিদুল ইসলাম জানান, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাদের কাছে আটশ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী ও ৩২ লাখ নগদ টাকা জমা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। শুক্রবারও বেশকিছু ত্রাণ ও নগদ টাকা এসেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য এভাবে এগিয়ে আসার বিষয়টি ভুলবেন না বলে জানাচ্ছেন অনেক শরণার্থী। তাদের মধ্যে একজন রাথিডং থেকে আসা আবদুল মালেক। তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশিরা পারছে না শুধু তাদের কলিজা কেটে খাওয়াতে। তারা যা করছে তা আমরা কোনোদিন ভুলবো না।

     পুরনোদের কারণে ত্রাণ পাচ্ছে না নতুনরা: বিপুল সংখ্যক ত্রাণ বিতরণের পরও পুরনো শরণার্থীদের কারণে নতুন আসা শরণার্থীরা ত্রাণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। নতুনরা এখনো পর্যন্ত তাদের থাকার জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত থাকার সুযোগে পুরনো রোহিঙ্গারা নিজেদের নতুন শরণার্থী দাবি করে ত্রাণগুলো ভাগিয়ে নিচ্ছে। মূলত তাদের কারণেই ত্রাণ বিতরণে কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ত্রাণবাহী গাড়ির পেছনে ছুটে বেশকয়েকজন শিশু আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও অনেক ত্রাণ বিতরণকারীদের খুঁজে খুঁজে নতুন শরণার্থীদের ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা গেছে।

থামেনি অনুপ্রবেশ, উড়ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন এখনো থামেনি। নৃশংসতার ২০ দিন পার হলেও এখনো পর্যন্ত সেখানে থেমে থেমে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা যাচ্ছে। ফলে এখনো পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থামছে না। আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশ করছে।

Leave a comment