স্টাফ রিপোর্টার: উখিয়া-টেকনাফ সড়কের কুতুপালং আমতল থেকে বালুখালীর দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। সড়কের এই পথজুড়ে এখন কেবল মিয়ানমার ফেরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্রোত। শুধু সড়ক নয়, আশপাশের পাহাড় জমিতেও ঠাঁই হয়েছে হাজারো রোহিঙ্গার। কোনো গাড়ি সে পথ দিয়ে যেতেই ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গাদের ভিড় ঘিরে ধরে সেই গাড়িকে। ভিড় থেকে ভেসে আসে খাবার দেন-টাকা দেন? দুই তিনদিন ধরে খাইনি। শনিবার বেলা ১১টায় ওই পথ ঘুরে ঘুরে দেখা মিলেছে এমন হাহাকারের চিত্র।
গত মাসে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের হামলার পর সেখানে নতুন করে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। হত্যার শিকার ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ায় আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। সহায়-সম্বল হারিয়ে তাদের প্রায় সবাই এক কাপড়ে প্রবেশ করেছেন এদেশে। এরপর থেকে তাদের কারও জায়গা হয়েছে সড়কে, কারও বা পাহাড়ে-জমিতে। তাদের কারও কারও মাথার ওপর ত্রিপল থাকলেও বেশিরভাগই একেবারে খোলা আকাশের নিচে। এদেরই একজন কালামিয়া। বছর ষাটের কালামিয়ার মংডুর ঘরাখালী এলাকায় ছিলো গ্যারেজ। তাতে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিলো সংসার। কিন্তু নতুন করে অস্থিরতা শুরু হলে সেই গ্যারেজ তিলে তিলে গড়ে তোলা বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। জায়গা হয়েছে একটি গ্যারেজে। তাই কিছুদিন আগেও টাকা পয়সার মালিক থাকা কালামিয়া এখন একেবারেই পথের ভিখারি। কালামিয়া বলেন, আমার গ্যারেজ ছিলো, তাতেই বেশ ভালোই চলে যেতো সংসারের খরচপাতি। কিন্তু অস্থিরতা শুরু হলে সেনাবাহিনী আমার এক ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলে। তাই পরিবারের ৯ সদস্যকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। এরপর এক পরিচিতের মাধ্যমে গ্যারেজে উঠেছি। গত দুইদিনে আমরা একবেলা খেতে পেরেছি। তাই ভিক্ষা করছি। পাশেই ভিক্ষা করছিলো রহমত উল্লাহ নামে আট বছর বয়সী এক শিশু। রহমত উল্লাহ বলে, গতপরশু থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত মাত্র একবেলা খাবার খেয়েছে সে। তার দাবি বাবাকে সেনাবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলেছে। তার মা ও আরেক ছোটভাইসহ তাকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এখন কিছু খাবার কিনতে ভিক্ষা করছে সে। লুখালী এলাকায় কথা হয় আসমা নামের এক নারীর সাথে। হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া ও ক্ষিদের জ্বালায় স্বামী সৈয়দুল আমিন খুব অসুস্থ। আসমা দাবি করেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার এক ছেলে ও এক মেয়েকে পুড়িয়ে মেরে ফেলছে। পরে তারা কোনোরকম পালিয়ে এসেছেন। এরপর থেকে চিড়া বিস্কুট জুটেছে তাদের কপালে। তবে হোসনে আরা নামের আরেক নারীর কপালে কিছু খাবার জুটেছে। তিনি বলেন, আমার তিন আনা পরিমাণ কানের দুল ছিলো। সে দুল আট হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি। ফলে আপাতত ভাত খেতে পারছি। কিন্তু টাকা শেষ হলে আমাকেও ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হবে। পথে পথে কথা হয় আরও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে। তাদের প্রায় সবারই এক কথা তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আত্মীয়স্বজনদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় সবাই এক কাপড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।
এদিকে ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন সামাজিক ও ইসলামিক সংগঠন ট্রাকে করে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে। পরে ট্রাক থেকে সেই ত্রাণের প্যাকেট তারা রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে ছুড়ে মারছেন। শুধু খাবার নয়, কেউ কেউ নতুন ও পুরনো কাপড়ও দিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের।