দামুড়হুদার নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন টেন্ডারকৃত স্থানেই নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন

 

ভবন নির্মাণে বাঁধা জনগণের লালিত স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করার শামিল

দামুড়হুদা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদের কমপ্লেক্স ভবন পূর্ব নির্ধারিত (টেন্ডারকৃত) স্থনেই নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার জনসাধারণ। গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে নাটুদহ ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফির নেতৃত্বে নাটুদহ ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার জনগণ চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সামনে মানবন্ধন করেন।

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন নাটুদহ ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফি, ইউপি সদস্য আব্দার আলী, জসিম উদ্দীন, কলিম উদ্দীন, আব্বাস আলী, ইসতোতারা, আব্দুল কুদ্দুস, জবেদ আলী, শিক্ষক হারুণ অর রশিদ, ফেরদৌস আলম, হারুণ, আ.লীগ নেতা সেলিম খান, মিয়াজদ্দীন, জাহান আলী, আশাদুল হক, নাজমুল হোসেন প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলাধীন ৮ নং নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদ নবগঠিত ইউনিয়ন হিসেবে গত ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যগণ শপথ গ্রহণের পর পরই ভবন নির্মাণের বিষয়ে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ইউপি সদস্যগণ ও স্থানীয় গণ্যমান্য  ব্যক্তিবর্গ নাটুদহ মৌজায় (সদর পুকুরে) নবগঠিত নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মিত হোক মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিষয়টি দামুড়হুদার তৎকালীন ইউএনও দামুড়হুদা এবং ডিডিএলজি চুয়াডাঙ্গা মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এতে উভয়ই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। জনগণের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য জনগণের টাকায় নাটুদহ মৌজার পাকারাস্তার পাশেই ২৭ কাঠা জমি কেনা হয়। উক্ত ক্রয়কৃত জমির পাশ দিয়ে ৫৪ ফুট সরকারি রাস্তা রয়েছে। যা বোয়ালমারী গ্রামের ঈদগাহের রাস্তার সাথে মিলে যাবে। এতে করে বোয়ালমারী জগন্নাথপুর গোচিয়ারপাড়া এবং খলিশাগাড়ি গ্রামের লোকজন অতি সহজে ইউনিয়ন পরিষদে আসতে পারবেন। অর্থাৎ সব ওয়ার্ডের মধ্যবর্তী স্থানেই ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মিত হবে। ক্রয়কৃত জমির পাশেই ৩-৪ বিঘা সরকারি খাস জমি রয়েছে। যা ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ক্রয়কৃত জমি ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে ওই স্থানে (নাটুদহ মৌজার সদর পুকুরে) নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণের জন্য সুপারিশ করেন। ভবন স্থাপনের বিষয়টি কার্যকরী করার লক্ষ্যে যাবতীয় অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভবন নির্মাণের টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডারকৃত স্থানে ভবন নির্মাণ শুরু ও শেষ হওয়ার তারিখ, প্রকাল্লিত মূল্য সম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপিত হয় এবং ইট বালিসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী ওই জমির পাশেই ফেলা হয়। কিন্ত হঠাত করে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে কতিপয় অসাধু ষড়যন্ত্রকারী ও স্বার্থান্বেষী মহল ওই স্থানে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ যাতে না হতে পারে সে বিষয়ে নীল নকশা তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ভবন নির্মাণে তাদের আকস্মিক এ বাঁধা জনগণের লালিত স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করার শামিল। এমতাবস্থায় টেন্ডারকৃত স্থানেই (সদর পুকুরে) ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জোর দাবি জানানা বক্তারা।

নাটুদহ সদর পুকুরে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের যৌতিকতা তুলে ধরে বক্তারা আরও বলেন, ব্রিটিশ শাসন আমলে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হলে সে সময় ভারতের ২৪ পরগনার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব শ্রী মধুসুদন পালের একমাত্র সন্তান শ্রী নফরপাল চৌধুরী ব্রিটিশদের কাছ থেকে নাটুদহ অঞ্চলটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেন এবং নাটুদহ সদর স্ট্রেট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জমিদারি কার্যক্রম চালু করেন। প্রায় দেড়শ বছর ধরে চলে ওই জমিদারি প্রথা। পরে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির মধ্যদিয়ে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি হয়। জমিদার নফরপাল চৌধুরী ছিলেন একজন শিক্ষিত প্রজা হিতৈষী মনের মানুষ। জমিদার গিন্নী শ্রী রাধা রানীও ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তৎকালিন সময়ে এলাকায় ছিলো অধিকাংশ অশিক্ষিত লোকের বসবাস। শিক্ষার আলো গরিব প্রজাদের ছেলে-মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ওই জমিদার গিন্নীই প্রথম স্বপ্নের বীজ বপন করেন। তারই অনুরোধে জমিদার নফর পাল চৌধুরী জমিদার ভবনের উত্তর পাশে জোলের ধার ঘেষে একটি পাঠশালা নির্মাণ করেন। খড়ের ছাউনি দিয়ে নির্মিত পাঠশালায় এলাকার ছেলে মেয়েরা প্রথম দিকে ঠিকমত আসতে না চাইলে জমিদার গিন্নী ওই সমস্ত ছেলে-মেয়েদের জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করলেন। এরপর পর্যায়ক্রমে ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের পদচানরায় ভরে ওঠে পাঠশালা প্রাঙ্গণ। পাঠশালায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়তে থাকায় জমিদার বাবু ১৯০৬ সালে স্ত্রীর নামে এক হাজার দরজা বিশিষ্ট একটি স্কুলভবন গড়ে তোলেন। নাম দেয়া হয় রাধা রানী ইনস্টিটিউট। ওই স্কুলে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করানোর মতো এলাকায় শিক্ষিত কোনো লোক না পেয়ে তিনি গিন্নীর অনুরোধে সুদুর কোলকাতা থেকে মোটা অঙ্কের মাইনে দিয়ে শ্রী নরেন্দ্রনাথ সিংহকে এনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। ওই স্কুলটি হাজার দুয়ারি স্কুল নামে পরিচিত ছিলো। পরবর্তীতে ওই স্কুলটির নাম পরিবর্তণ করা হয়। যা বর্তমানে নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচালিত হয়ে আসছে। জমিদার মহলটি ছিলো নাটুদহ সদরে। চারদিক সুবিশাল সিংহমার্কা সুন্দর আকৃতির মেইন গেট। গেটের উত্তর পাশে ছিলো দুটি বিশাল মন্দির। ছিলো জমিদার ভবনের সাথে গোপন রাস্তা সংযুক্ত বিশাল খিড়কির একটি পুকুর। পাঁকা সিঁড়ি সংযুক্ত ওই পুকুরে জমিদার গিন্নী স্নান করতেন আর পড়ন্ত বিকেলে জমিদার বাবু গিন্নীকে নিয়ে ওই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতেন। পুকুরের উত্তর পাশে প্রজাদের জন্য গড়ে তোলা হয় একটি আমবাগান। জমিদার ভবনের পশ্চিম পাশে জনসাধারণের জন্য তৈরি করা হয় একটি সান বাঁধানো পুকুর। যা আজ সদর পুকুর নামে পরিচিত। পুকুরের দক্ষিণ পাশে ছিলো জমিদার বাবুর ঘোড়াষাল বা ঘোড়ার ঘর। ঘোড়ার ঘরের পাশেই তৈরি করা হয় আলাদা একটি পুকুর। যেখানে শুধু ঘোড়ার গা ধোয়ানো হতো। এরই এক প্রান্তে নির্মাণ করা হয় একটি পোস্ট অফিস। যা বর্তমানে নাটুদা পোস্ট অফিস নামে পরিচালিত হয়ে আসছে। পোস্ট অফিসের পাশেই গড়ে তোলা হয় একটি ডাক্তারখানা। যেখানে গরিব দুস্থ প্রজাদের বিনামূল্যে দেয়া হতো চিকিৎসা সেবা। জমিদার নফরপাল চৌধুরী ছিলেন তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে শ্রী সতীষচন্দ্র পাল, মেজ ছেলে জতীষচন্দ্র পাল এবং ছোট ছেলের নাম ছিলো শ্রী ক্ষিতিষচন্দ্র পাল। ছোট ছেলে ক্ষিতিষচন্দ্র পালের ছিলো ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ঝোক। তিনি এমএ পাশ করার পর পিএইচডি ডিগ্রি লাভের জন্য ছুটে যান সুদুর লন্ডনে। সেখানে খেলাপড়া করাকালিন তিনি টেমস নদীর তীরে একটি সুবিশাল অট্রালিকা দেখে মুগ্ধ হন এবং হুবহু ওই অট্টালিকার মতই একটি অট্টালিকা নির্মাণের জন্য বাবার কাছে অনুরোধ জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। জমিদার বাবু তার ছোট ছেলের ইচ্ছা পূরণ করতে ওই অট্টালিকার মতই হুবহু একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন। আর ওই অট্টালিকার সামনে জমিদার গিন্নী গড়ে তোলেন একটি মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান। কামিনী, দোলনচাপা আর হাসনাহেনার গন্ধে মন ভরে উঠতো পথচারীদের।

অতপর ১৯৩৫ সালের শেষের দিকে শ্রী নফর পাল চৌধুরী সকলকে কাঁদিয়ে পরোলক গমন করেন। তার মৃত্যুর পর তিন ছেলের মধ্যে জমিদারি ভাগ হয়ে যায়। বড় ছেলে সতিষচন্দ্র পাল নাটুদহ সদরস্ট্রেট, বাগোয়ান, কার্পাসডাঙ্গা হাতাবাড়ি ও মেমনগর মৌজা পারিবারিকসূত্রে প্রাপ্ত হন। বাকি দুঅংশ অপর দু ছেলে প্রাপ্ত হন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সম্রাজের অবসান হয় এবং তৎকালিন গর্ভনর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের নেতৃত্বে দেশ বিভক্ত হয়। সৃস্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশ। রাষ্ট্রীয়ভাবে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গৃহিত হলে জমিদার সতীষচন্দ্র পাল স্বেচ্ছায় তার যাবতীয় সম্মত্তি প্রজাদের মাঝে বিলি করে এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। বর্তমানে ওই সমস্ত সম্মত্তির বেশীরভাগই এনিমি বা শত্রু সম্মত্তি হয়ে গেছে। পরবর্তীতে জমিদার বাবুর ওই সমস্ত অট্টালিকা এলাকার এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল কৌশলে ভেঙে বিক্রি করে দেয়। কালের বিবর্তনে জমিদার বাবুর অধিকাংশ কীর্তি ধ্বংস হলেও শুধু কালের সাক্ষী হয়ে আজও স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে জমিদার বাড়ির প্রবেশদ্বারে স্থাপিত দুটি মন্দির। নাটুদহ সদরের সেই পুরাতন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে অন্তত পক্ষে এখনেই হওয়া উচিত নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন। এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি পূরণে আপনাদের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করা হলো। মানববন্ধন শেষে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের হাতে  দেড়শ পৃষ্ঠার ইউনিয়নের ২১৮১ জনের স্বাক্ষর সংবলিত গণস্বাক্ষরপত্রসহ ১২ জন ইউপি সদস্যের স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি পেশ করা হয়।

 

Leave a comment