রাজধানীতে তিন সন্তানসহ মায়ের রহস্যজনক মৃত্যু
স্টাফ রিপোর্টার: গলায় ওড়না প্যাচানো মা ঝুলছে ফ্যানের সাথে। পাশের রুমে তিন শিশু সন্তানের লাশ শোয়ানো পাশের রুমে। আর তাদের মধ্যে একজনের লাশের দুই পা রশি দিয়ে বাঁধা। বেদনাদায়ক এ দৃশ্যটি রাজধানীর তুরাগের কালিয়ারটেক এলাকার একটি টিনশেড বাড়ির । নিহত মায়ের নাম রেহেনা আক্তার (৩৮)। আর তিন শিশু সন্তান হচ্ছে বড় মেয়ে শান্তা (১২), ছোট মেয়ে শেফা (৮) ও আট মাসের ছেলে সাদ। তুরাগ থানা পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতে এ চারজনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। তবে তাদের মৃত্যু নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। নিহত রেহেনার স্বামী মোস্তফা কামাল দাবি করেছেন, এক সময় সংসারে সচ্ছলতা ছিলো। কিন্তু সম্প্রতি সংসারের অর্থ সঙ্কটের কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তার স্ত্রী এ ঘটনা ঘটাতে পারে। অপর দিকে রেহানার স্বজনরা দাবি করেছেন, স্বামী কামালের ভাই ও বোনেরা পরিকল্পিত ভাবে তাকে হত্যা করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, এটা হত্যা না আত্মহত্যা তা ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে। ময়না তদন্ত শেষে চারজনের লাশ গতকাল বিকালে তুরাগের কামারপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি
নিহত গৃহবধূর স্বামীর কথা: গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরী বিভাগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রেহেনার স্বামী মোস্তফা বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একসাথে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ইফতার করেন। তারপর এলাকার যুব কল্যাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কো-অপারেটিভ লিমিটেডের অফিসে যান। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এই সমিতিতে তিনি নিয়মিত বসতেন। রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরে দেখেন, সামনের ঘরে আলো, কিন্তু কেউ নাই। মাঝের ঘরে বিছানায় তিন সন্তান এবং ভেতরের ঘরে ফ্যানের সঙ্গে রেহেনা ঝুলছে। তিনি চিত্কার দেন। আশপাশের মানুষও ছুটে এসে রেহেনাকে নিচে নামায়। এ সময় বুঝতে পারেননি তিন সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় বড় পদে ভালো বেতনে চাকরি করতেন। পরে ফ্ল্যাটের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান হলে কিছুদিন ধরে অর্থ সংকট চলছিল। তিনি আগে ডেসটিনির সাথে জড়িত ছিলেন। সেখানে তার ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। বর্তমানে কামারপাড়ায় ‘যুবকল্যাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কো-অপারেটিভ লিমিটেড নামে তার একটি সমিতি রয়েছে। ব্যবসায়ীদের কিস্তিতে ঋণ দিতে এটি চালু করেছেন। তবে এখনো কাজ শুরু হয়নি। আগে তার অবস্থা ভালো থাকায় সন্তানরা অসুস্থ হলে বড় বড় হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সা করাতেন। আয় না থাকায় ইদানিং শুধু ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনতেন। তারপর তার পরিবারের সাথে তার নিজের, স্ত্রী ও সন্তানদের ভালো সম্পর্ক ছিলো না। ফরিদগঞ্জে তার পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে। সেই জমি বিক্রি করতে চাইলেও ভাই-বোনরা তা বিক্রি করতে দিচ্ছিলো না। এসব নিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে তার পরিবারের লোকজনের প্রায় ঝগড়া হতো। এতে রেহানা এক প্রকারে মানসিক যন্ত্রনার শিকার হতো। মূলত সংসারে অভাব-অনটন আর মানসিক অত্যাচারের কারণেই সন্তানদের হত্যার পর স্ত্রী রেহানা আত্মহত্যা করতে পারে বলে কামালের দাবি।
রেহানার স্বজনরা যা বলছে: নিহত রেহানার ভাগ্নি আসমা আক্তার বিথী বলেন, তার খালা আত্মহত্যা করেননি, তিনি সন্তানদেরও হত্যা করেনি। খালা মাস্টার্স পাস করা একজন মেয়ে। সে এই কাজ করতে পারে না। বিথীর অভিযোগ, তার খালুর (কামালের) পরিবার রেহানাকে ও তার সন্তানদের দেখতে পারতো না। তাদের খোঁজ নিতো না। কামাল তার পৈতৃক জমি বিক্রি করতে চাইতো। কিন্তু তার পরিবার বাধা দিত। এ কারণে কামালের ভাই আনোয়ার, দেলোয়ার, বোন কহিনুর ও তার স্বামী মোক্তার এদের হত্যা করেছে।
রেহানার ভাই মাহবুব আলম বলেন, কালিয়ারটেকের বাড়িটি তাদের ভগ্নিপতি কামালের পৈতৃক সম্পত্তি। তাদের সম্পত্তির একটি অংশ ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু এই টাকার অংশ মোস্তফা কামালকে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে রেহেনার সঙ্গে মোস্তফার মা, দেবর, ননদ ও ননদের স্বামীর প্রায়ই ঝগড়া হতো। এরই জের ধরে রেহেনা ও তার সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। রেহেনার বোন রোজিনা সুলতানা বলেন, শাশুড়ি, ননদসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের হত্যা করেছে। ১৭ বছর তাদের বিবাহিত জীবন। কোনোদিন আমার বোনকে শান্তি দেয়নি তারা।
ময়না তদন্ত ঃ তদন্তকারী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাক্তার সোহেল মাহমুদ বলেন, প্রাথমিক ভাবে তিন শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যার প্রাথমিক প্রমান পাওয়া গেছে। তবে মায়ের মৃত্যু কী ভাবে হয়েছে তা সে ব্যাপারে এখনও আমরা কনফার্ম হতে পারিনি। তিনি বলেন, মায়ের মৃত্যুর কারণ জানতে ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এই রিপোর্ট এলে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। গতকাল শুক্রবার বিকালে ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। এর আগে মরদেহগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন তুরাগ থানার এসআই খগেন্দ চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, লাশের শরীরে অন্য কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শুধু গলায় দাগ পাওয়া গিয়েছে। গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগানো ছিল। সন্তানদের হত্যার পর মা আত্মহত্যা করতে পারেন বলে পুলিশের ধারণা।
তুরাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবে খোদা বলেনা, পারিপার্শিক অবস্থা পর্যালোনা করে প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তিন সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছে। তবে এ পেছনে অন্য কিছু রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।