পুনঃস্থাপন মন্দের ভালো : বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া

 

ভাস্কর্য নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে

স্টাফ রিপোর্টার: সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনকে মন্দের ভালো হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকে। তারা মনে করছেন, ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে। সরকার দুই পক্ষকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছে, যা বিপজ্জনক। সুপ্রিম কোর্টের মূল প্রবেশপথে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পাঁচ মাসের মাথায় কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে গত বৃহস্পতিবার রাতে সেটি সরানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে দেশের ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেছিলেন, ধর্মান্ধ শক্তির কাছে সরকার নতি স্বীকার করেছে। ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখে ভাস্কর্য সরানোর এক দিন পর গত শনিবার রাতে ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের বর্ধিত (অ্যানেক্স) ভবনের সামনে আবার স্থাপন করা হয়। জানতে চাইলে গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যটি ছিলো। সরিয়েছেন প্রধান বিচারপতি, আবার পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্তও তিনিই নিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গতকাল বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজে সমস্ত আইনজীবীর সাথে কথা বলেছেন, তাঁরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাস্কর্যটি সরিয়ে পুনঃস্থাপন করেছেন। তবে সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিলেও এটা সরানোর বিষয়ে সরকারের ইচ্ছাই গুরুত্ব পায়। এটা পুনঃস্থাপনেও সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। ভাস্কর্যটি স্থানান্তর নিয়ে আক্ষেপ রয়ে গেছে ভাস্কর মৃণাল হকের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আগের জায়গাটিই ছিল এর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এখন বিষয়টি অনেকটা রূপবানকে বনবাসে দেওয়ার মতো হয়ে গেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমি মনে করি, ভাস্কর্যটি অপসারণ করা ঠিক হয়নি। তবে যদি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেই এটি পুনঃস্থাপিত হয়, তাহলে আমি সেটাকে মন্দের ভালো বলব। ভাস্কর্য স্থাপন, সরানো, পুনঃস্থাপন নিয়ে আছে নানামুখী প্রতিক্রিয়া। ভাস্কর্য সরানোয় প্রথমে হেফাজতে ইসলাম শুকরিয়া আদায় করে। বিক্ষোভ দেখান প্রগতিশীল সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পুনঃস্থাপনের পর উদারপন্থীরা পুরোপুরি খুশি না হলেও কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। তবে আবারও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, এ পদক্ষেপে তারা ‘বিস্মিত, হতবাক ও বাকরুদ্ধ। তবে পুরো প্রক্রিয়াটিতে ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখে সরকার সব পক্ষকে মোটামুটি খুশি রাখার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন অনেকে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও মনে করেন, ভাস্কর্যের বিষয়টি নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে। তিনি বলেন, মৌলবাদীরা ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে এমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি যে তা সরাতে হবে। সরকার যা করেছে তা বিপজ্জনক এবং লজ্জাজনক। সরকার হেফাজতে ইসলামের সক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাস্কর্য সরানোর পর উদারপন্থীদের পাল্টা দাবির মুখে সেটি আরেক জায়গায় স্থাপন করা হলো। কিন্তু এখানে হেফাজতে ইসলামের সাফল্য এসেছে। এখানে মৌলবাদীরা থেমে যাবে না। তিনি বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এখনই শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। না হলে এ দেশ একসময় বাসযোগ্য থাকবে না।

ভাস্কর্য সরানোর ঘটনাকে হেফাজতে ইসলাম চিহ্নিত করেছিলো প্রাথমিক বিজয় হিসেবে, সেই সঙ্গে তারা দেশের সব ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তোলে। অনেকে মনে করেন, ভাস্কর্য সরানোর ঘটনা মৌলবাদী গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করেছে। সরকারের উচিত হবে কঠোর হওয়া। সরকারের ভেতরেও এই মত আছে। সরকারের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের এই ভাস্কর্যকে উপলক্ষ করে হেফাজতে ইসলাম জঙ্গিবাদী অপরাজনীতির জিগির তোলার চেষ্টা করছে। তাদের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। দেশের সব ভাস্কর্য রক্ষার দাবি জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপনের অধিকার প্রদান করে। সংবিধানের এই অধিকার ধর্মবিরোধী নয়, ধর্মের অসম্মানও নয়, এটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি রক্ষার মৌলিক অধিকার। এই অধিকার রক্ষার জন্য সব ভাস্কর্য ও শিল্প-সাহিত্যের চর্চা অক্ষুণ্ণ রাখা সরকার ও প্রশাসনের পবিত্র দায়িত্ব। জাসদ আশা করে, সরকার সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে সফলভাবে এ দায়িত্ব পালন করবে। একবার ভাস্কর্য স্থাপন, এরপর সরানো, পরে আবার আরেক জায়গায় স্থানান্তর- পুরো প্রক্রিয়াটিকে সরকারের জন্য শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা হিসেবে দেখছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি বলেন, সরকার যে দোলাচলে আছে, তা বোঝা গেলো। সরকারের অবস্থান শক্ত বলে মনে হয় না। সরকার দুই নৌকায় পা রাখছে। তিনি বলেন, এখন নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো- এই সান্ত্বনা নিয়ে থাকতে হচ্ছে। ভাস্কর্য সরানোটা একধরনের নতি স্বীকার। এটি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে একধরনের রফা হলো। কিন্তু একবার পিছিয়ে গেলে বারবার পিছিয়ে যেতে হবে। তবে অনেকে মনে করেন, সরকার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কিছুটা ধর্মভীরু, সাম্প্রদায়িক এবং কিছুটা ধর্মনিরপেক্ষ। তারা একদিকে ওয়াজ শুনে কেঁদে বুক ভাসায়, অন্যদিকে যাত্রায় গিয়ে নাচে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী বাস্তবধর্মী যথাযথ কাজ করেছেন বলে তিনি মনে করেন।

সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের সিদ্ধান্তে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিমকোর্টে প্রবেশের মূল ফটক বরাবর থাকা লিলি ফোয়ারায় ভাস্কর্যটি বসানো হয়। পরে এ ব্যাপারে সরকারের পরামর্শে আদালত এটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে ভাস্কর্যটি সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার আগে ওই দিনই আইনজীবীদের সাথে বৈঠক করে তাঁদের মতামত নেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্ট ও প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার স্বার্থে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়ার পক্ষে মত দেন বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জানিয়েছেন। তবে ভাস্কর্যটি কোথায় পুনঃস্থাপন করা হবে, সে বিষয়ে ওই বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বৈঠকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কীভাবে কোথা থেকে কী হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রথমে বলা হলো ভাস্কর্যটি রুচিপূর্ণ ছিল না। তাহলে এটি কোন প্রক্রিয়ায় এল, আবার কোন প্রক্রিয়ায় সরানো হলো, কীভাবেই আবার পুনঃস্থাপন হলো- এ ধরনের নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সরকারের উচিত এই বিভ্রান্তি দূর করা।

 

Leave a comment