স্টাফ রিপোটার: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় গতবছর টিআর, জিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের ব্যাপক হরিলুটের পর চলতি অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিসহ পুকুর চুরির অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রকল্প চেয়ারম্যানরা বহাল তবিয়তে এসব দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব তালিকার শ্রমিকদের নাম বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পিআইসিগণ দলীয় ও অনুগত শ্রমিকদের তালিকাভুক্ত করে হতদরিদ্রদের পরিবর্তে অর্থশালী লোকজনকে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কাজ না করে একই শ্রমিক একাধিক নামের টিপসহি দিয়ে টাকা উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে। কর্মসৃজন কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনায় জনমনে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় জনতা এসব প্রকল্পের দুনীতির তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
অভিযোগে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলার ৮ ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের মাঝে কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় চলতি অর্থবছরে কাজ শুরু হয়েছে। স্ব স্ব ইউপি সদস্যগণকে প্রকল্প চেয়ারম্যান র্নিবাচিত করে প্রকল্পের কাজ প্রতিটি ইউনিয়নে পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের কাজের শুরুতে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি দেখা দিয়েছে। প্রকৃত হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে স্বজনপ্রীতি, দলীয় ও আত্মীয়তাকরণের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পে তালিকাভুক্ত অনেক শ্রমিক কাজ না করে একই ব্যক্তি অনুস্থিত শ্রমিকদের নামে একাধিক টিপসহি দিয়ে টাকা উত্তোলন করছেন। বঞ্চিত শ্রমিকদের দাবি অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে শ্রমিকদের নাম তালিকাভুক্ত করা হলেও এব্যাপারে কোথাও অভিযোগ করে কোনো কাজ হচ্ছে না।
সরেজমিনে গত রোববার উপজেলার আন্দুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রকল্পের দুই নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে তালিকায় ২৮ জন শ্রমিকের নাম রয়েছে। দেখা গেছে, ১১ জন শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। সাংবাদিক উপস্থিত দেখে প্রকল্পের পার্শ্ববর্তী একটি কলাবগান থেকে ২-৩ জন শ্রমিক বের হয়ে আসেন। তারা কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমিক হলেও প্রকল্প চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য শেখ হাফিজুর রহমানের কলাবাগান পরিচর্যার কাজ করছিলেন। শ্রমিকদের নিকট খবর পেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পিআইসি ইউপি সদস্য শেখ হাফিজুর রহমান ও জালাল উদ্দিন মল্লিক মোটর সাইকেলযোগে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছান। আগন্তক জালাল উদ্দিন মল্লিক নিজেকে এ কর্মসৃজন প্রকল্পের তালিকাভুক্ত শ্রমিক বলে দাবি করেন। প্রকল্প ছেড়ে পিআইসির সাথে ঘুরছেন কেন? এ প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি।
অপরদিকে প্রকল্প চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য শেখ হাফিজুর রহমানের নিকট ২৮ জন শ্রমিকের স্থলে ১১ জন শ্রমিক কর্মরত কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাকি শ্রমিক ইউনিয়নের নিধিকুণ্ডু এলাকায় কাজ করছেন। সত্যতা জানতে এ প্রতিবেদক নিধিকুণ্ডু এলাকা ঘুরে কোথাও কর্মসৃজন প্রকল্পের শ্রমিকদের সন্ধান মেলাতে পারেনি। সত্যতা না মেলায় মুটোফোনে, প্রকল্প চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য শেখ হাফিজুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে করেন না।
সূত্র জানান, গত বৃহস্পতিবার উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা সরেজমিনে ওই প্রকল্প পরিদর্শনকালে একই চিত্র পায়। অজ্ঞাত কারণে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্য ও প্রকল্প চেয়ারম্যান মিনুয়ারা খাতুনের প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দুপুর ১২টার দিকে শ্রমিকেরা কাজ করে চলে গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা এ প্রকল্পে অভিযোগ তুলে বলেন, অল্প সংখ্যক শ্রমিকদিয়ে নামমাত্র কাজ করা হচ্ছে। ইউনিয়নের সব প্রকল্পে একই চিত্র বলে প্রাপ্ত তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য ও অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, নীতিমালা মোতাবেক পদাধিকার বলে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ এ কর্মসূচির তালিকা প্রস্তুত করেন। তালিকা প্রস্তুতকালে চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ প্রভাব খাটিয়ে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। প্রকল্প পিআইসিগণ প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম ও ভোটে সমর্থন না করার অপরাধে গত বছরের তালিকাভুক্ত অনেক শ্রমিককে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এ কর্মসূচির ২ নম্বর বর্ণিত শর্তে পূর্ববর্তী বছরের তালিকা থেকে পরবর্তী বছরের তালিকায় কোনো নাম পরিবর্তন করা যাবে না। যদি কোনো শ্রমিক মারা যান অথবা অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে ওই পরিবার থেকে কাজ করতে সক্ষম এমন ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে।
হাসাদহ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মতিয়ার রহমান বলেন, শ্রমিকদের তালিকা প্রণয়নকালে ব্যাপক দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ও প্যানেল চেয়ারম্যান জুম্মাত মণ্ডল তালিকা প্রস্তুত করেছেন। সেই তালিকায় হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে এলাকার অবস্থা সম্পন্ন ও জমি জায়গার মালিককে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় অনেক শ্রমিকের নাম থাকলেও কাজের সময় তাদের দেখা যায়নি।
এদিকে সীমান্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়েন উদ্দিন ময়েন বলছেন, আমার ইউনিয়নে কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ মাত্র একদিন হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তালিকা প্রস্তত না হওয়ায় এমপি সাহেবের নির্দেশে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। হতদরিদ্র শ্রমিকেরা কাজের সুযোগ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এদিকে কর্মরত শ্রমিকদের অভিযোগ তারা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাজ করলেও এখনও পর্যন্ত টাকা উত্তোলন করতে পারেননি। নিয়মিত কাজ করেও নির্ধারিত সময়ে টাকা উত্তোলন করতে না পেরে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতন জীবনযাপন করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিধিকুণ্ডু গ্রামের এক শ্রমিক অভিযোগ তুলে বলেন, আমাদের গ্রামের ১০ জন শ্রমিকের নাম তালিকায় থাকলেও তাদের এ বছর কাজে নেয়া হয়নি।
অন্যদিকে সম্প্রতি বদলি শ্রমিক হিসেবে দুজনকে কাজে নিয়োজিত করেছেন। তবে এ সব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ট্যাগ অফিসারের নিকট অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরুল হাফিজ বলেন, কর্মসৃজন কাজের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে সীমান্ত ইউনিয়নে অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে। অতিসত্বর তা চালু করা হবে।