ইন্টার্ন ডাক্তারদের কর্মবিরতি দেশব্যাপী রোগীদের ভোগান্তি

 

স্টাফ রিপোর্টার: এক রোগীর স্বজনদের মারধরের ঘটনায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের চার শিক্ষানবিশ চিকিত্সকের ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। অবশ্য ওই ঘটনার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন বলা হয়, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ইন্টার্ন চিকিত্সকরা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনার পর ইন্টার্ন চিকিত্সকদের কর্তব্যে অবহেলার কারণে সেই রোগী মারা যায়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইন্টার্নশিপ স্থগিত করার আদেশের প্রতিবাদে শজিমেকসহ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন চিকিত্সকরা কর্মবিরতি পালন করছেন। আর এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিত্সা নিতে আসা রোগীরা। পরে এই আন্দোলন দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা চিকিত্সা মহাবিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, অবিলম্বে ইন্টার্নশিপ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হোক।

সরেজমিনে স্থানীয় প্রতিনিধি রোগী ও অভিভাবকদের সাথে আলাপকালে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, রোগীর ওপর হামলার বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জড়িত চিকিত্সকদের শাস্তি দেয়া যাবে না- এটা কী মগের মুল্লুক। কথায় কথায় রোগীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। স্থানীয় গণ্যমান্য ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, আন্দোলনের নেপথ্যে সরকার বিরোধী একটি মহল জড়িত। এই মহলের চক্রান্তে তারা সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের মতো একই কায়দায় দাবি আদায়ের নামে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিএমএ’র মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসবেন। আন্দোলনের নেপথ্যে বিএমএ’র কোন কোন নেতা জড়িত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ কেউ থাকতে পারে। আন্দোলন উস্কে দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টাও করতে পারে। বিষয়টি আমরা সতর্কতার সঙ্গে দেখছি।

স্বাচিবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সেলান বলেন, স্বাচিবের পক্ষ থেকে আন্দোলন নিরসনের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। স্বাচিবের কোন কোন নেতা এই আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ কেউ থাকতে পারে। তবে বিষয়টি যাতে বেশিদূর না যায়। বিষয়টি দ্রুত নিরসনের জন্য তিনি নীতিনির্ধারক মহলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তবে আন্দোলনের উসকানি দিচ্ছে স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিব) ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) একাধিক নেতা। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। নিজেদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতেই তারা উস্কানি দিচ্ছেন। গোয়েন্দা সংস্থা ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তি হয়েছে, এ নিয়ে আন্দোলন অযৌক্তিক। রোগীর স্বজনদের ওপরে যারা হামলা করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রোগীদের জিম্মি করে আন্দোলন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নেপথ্যের উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বগুড়া অফিস জানায়, টানা চতুর্থ দিনেও কাজে ফেরেনি বগুড়া শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিত্সকরা। রোববার বহিঃবিভাগ (আউটডোর) ও কলেজ বন্ধ করে শজিমেক হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিত্সকরা তাদের কর্মসূচি পালন করে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইন্টার্ন চিকিত্সকরা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে মানববন্ধন ও মিছিল করেছে। তবে হাসপাতালে চিকিত্সা সেবায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। এর ফলে মেডিকেল কলেজে ঘণ্টাখানেক কোন ক্লাশ হয়নি। মানববন্ধন থেকে ইন্টার্ন চিকিত্সকদের মুখপাত্র শাস্তি পাওয়া ইন্টার্ণ চিকিত্সক কুতুব উদ্দিন বলেন, শাস্তি দিলে দুপক্ষকেই দেয়া উচিত, একটি বিশেষ এলাকার লোক হওয়ায় রোগীর স্বজনদের ছাড় দেয়া হয়েছে। তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসুচি অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি ।

সরেজমিনে রোববার সকালে শজিমেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকের সামনে রাস্তার উপর ইন্টার্ন চিকিত্সকসহ কলেজের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনে যোগ দেয়। পরে তারা বেলা ১১ টার দিকে মিছিল নিয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে যায়। মানববন্ধনকালে ইন্টার্ন চিকিত্সকরা হাসপাতালের বহি:বিভাগ দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন্ধ ঘোষনা করে। এছাড়াও ইন্টার্ন চিকিত্সকদের সাথে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মানবন্ধনে অংশ নিতে দেখা যায়। বহি: বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, অনেক রোগী বাইরে বসে আছে। বগুড়ার ধাওয়া পাড়া থেকে বহি:বিভাগে সেবা নিতে আসা রোকেয়া বেগম জানান, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরে জানিয়ে দেয়া হয় মানববন্ধন কর্মসুচির জন্য ১২টার আগে কোন টিকেট দেয়াসহ রোগী দেখা হবে না। শহরের চেলোপাড়া থেকে আউটডোরে চিকিত্সা নিতে রেজাউল জানান, তার শিশুর চিকিত্সার জন্য আউটডোরে গেলেও বলে দেয়া হয় ১২ টার আগে টিকিট দেয়া হবে না।

বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. নির্মূলেন্দু চৌধুরী জানান, ইন্টার্ন চিকিত্সকরা আউটডোরে এক ঘন্টা রোগী না দেখার প্রস্তাব করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। হাসপাতালে চিকিত্সা সেবা কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। কর্তব্যরত চিকিত্সক ও নার্সরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে সেবা প্রদান করছেন। এক ঘণ্টা কলেজ বন্ধ থাকা বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি । হাসপাতালের অপর একটি সূত্র জানায়, আন্দোলনরত ইন্টার্ণ চিকিত্সকদের সাথে অন্যন্য চিকিত্সকরা সংহতি প্রকাশ করবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চিকিত্সক নেতৃবৃন্দ। আজ সোমবার এই সংহতি প্রকাশ করা হতে পারে বলেও জানিয়েছে সংশি­ষ্ট ঘনিষ্ঠ সূত্রটি। চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছে ইন্টার্নি চিকিত্সকরা। রোববার বেলা ১টা থেকে তারা ধর্মঘট শুরু করে। এতে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রোগীদের স্বাভাবিক চিকিত্সা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

ইন্টার্নিদের ধর্মঘটে হাসপাতালে চিকিত্সা সেবায় কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানান কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম মেডিকেলের উপপরিচালক ডা. দিদারুল ইসলাম বলেন, ইন্টার্নি চিকিত্সকদের ধর্মঘটের কারণে চিকিত্সা সেবায় সমস্যা হবে না। আমাদের হাসপাতালের অধীনে ২৭০ জন, চমেক’র অধীনে ২৪৭ জন, ৩০০ অনারারি মেডিকেল অফিসার, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের অধীনে ২০০ চিকিত্সক রয়েছে। রোগীদের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য হাসপাতালের চিকিত্সক ও নার্সদের সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে ২৬৩ জন ইন্টার্নি চিকিত্সক রয়েছে। বরিশাল অফিস জানায়, দ্বিতীয় দিনের ন্যায় বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিত্সা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে চলছে ইন্টার্ন চিকিত্সকদের কর্মবিরতি। ইন্টার্নদের অনুপস্থিতিতে রবিবার সকাল থেকে মেডিসিন ওয়ার্ড-ওয়ানে ভর্তি হতে আসা রোগীদের সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. এসএম সিরাজুল ইসলাম জানান, জরুরি বিভাগসহ অন্য বিভাগের রোগীদের সেবা অব্যাহত রাখতে মিড লেভেলের চিকিত্সকদের বাড়তি শ্রম দিতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বগুড়া মেডিকেল কলেজের সৃষ্ট ঘটনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে শনিবার দুপুর থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন শেবাচিম হাসপাতালের ১৯৯ জন ইন্টার্ন চিকিত্সক। ইনডোর ও আউটডোর সেবা চালু রাখতে মিড লেভেলের মেডিকেল অফিসার থেকে রেজিস্ট্রার পদধারী ১৫৯ চিকিত্সক বাড়তি দায়িত্ব পালন করছেন।

Leave a comment