কামরুজ্জামান বেল্টু: জীবনযুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ জয়ী না হলেও অভাব তাড়ানো যোদ্ধাদের প্রায় সকলেরই ‘যুদ্ধ’ নিয়ে অভিন্ন উক্তি। কোনো কাজই ছোট নয়, সে বড়াভাজা হোক আর ঝালমুড়ি বা কাগজের তৈরি ফুলবিক্রিই হোক। চুয়াডাঙ্গার রাস্তার ধারে বাদম বিক্রি করে অনেকেই ঘুরিয়ে চলেছেন তাদের ভাগ্যের চাকা। স্বল্পপুঁজির ক্ষুদ্র এসব ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের জীবনচিত্র কেমন? পথে পথে ঘুরে রোজ রোজগারই বা কতো? এসব জানতে গিয়ে রাস্তার পাশে বসে বড়াভাজা বিক্রেতার অর্থিক স্বচ্ছ্বলতার চমকপদ তথ্যই শুধু নয়, তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার অদম্য সংগ্রামের চিত্রও উঠে এসেছে সামনে।
চুয়াডাঙ্গা রেলবাজারের রাস্তার পাশে বসে পেঁয়াজু ও চপ ভাজা বিক্রেতার বাড়ি পৌরকলেজপাড়ায়। তার ৩ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে অর্নাস, দ্বিতীয় ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। ভাজা বিক্রেতার স্বল্প পুঁজি হলেও লাভ বেশি। লাভের কিছু অংশ সঞ্চয় করে একে একে ১০টি আলমসাধু কিনেছেন তিনি। তা থেকে প্রতিদিনের গড় আয় ২ হাজার টাকা। আর ভাজা বিক্রিতে? যা হয় তা দিয়ে সংসার ভালোই চলে। তিনি বললেন, এখকার এই আয় দেখলে তো হবে না, শুরুটাও বুঝতে হবে। রাস্তার পাশে বসে পেঁয়াজু চপ ভেজে বিক্রির কাজকে যদি ছোট করে দেখতাম আর সেই সংগ্রামের বদলে কামলা খাটতে যেতাম তা হলে কি আজকের স্বচ্ছ্বলতা আসতো? এক সময় তিনি ড্রাইভারিও করেছেন।
চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের শহীদ হাসান চত্ব¡রে সন্ধ্যার পরপরই বয়েল ডিমের ঝুড়ি নিয়ে কেরোসিনের কুপি জ্বেলে বসেন বেশ ক’জন। ভ্যানে অনেকেই ভাজেন বাদম-সোলা ছিমের বীজ। এদেরই একজন আলাউদ্দীন। তিনি রাস্তার একপাশে ভ্যানের ওপর চুলাজ্বালিয়ে গরম ভাজাবাদাম-ছোলা বিক্রি করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে হলেও দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে চুয়াডাঙ্গায় বসবাস করেন। ইসলামপাড়ায় থাকেন। বড়বাজারের শহীদ হাসান চত্ব¡রে বাদাম-ছোলা বিক্রি করেন মূলত সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। আয় জানেন কতো? সরাসরি না শুনে একটু হিসেবটা কষে নিলেই বোঝা যাবে তার বড়ভাইয়ের দোবাই যাওয়ার কাহিনী শুনে। আলাউদ্দিনের রাতে বাদাম বিক্রি হয় ১৪ থেকে ১৫ কেজি আর ছোলা বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ কেজি। কাঁচা বাদাম আর কাঁচা ছোলা কতোটাকা কেজি আর ভাজার পর বিক্রি করে কতোটাকা শ? অবাক হলেও সত্য আলাউদ্দীনকে ওই চর এলাকা থেকে বস্তা বস্তা বাদাম কিনে গোডাউনে রেখে চুয়াডাঙ্গায় ভাজা বাদামের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে এখন। বয়েল ডিম বিক্রেতাদেরও মুখে সব সময়ই লেগে থাকে স্বচ্ছলতার হাসি। শীতে সেটা একটু বেশি।
চুয়াডাঙ্গা ঠাকুরপুরের চাঁদ আলী বললেন, কাঁচা ডিম কিনে সিদ্ধ করে বয়েল করে বিক্রিতে ভালো লাভ। অল্প পুঁজিতে ভালো ব্যবসা। চুয়াডাঙ্গা স্টেশনের কাছে কাগজের তৈরি হরেক রকমের ফুল ফেরিওয়ালা জরহুল ইসলামের বাড়ি নওগার জাম গ্রামে। তিনি বললেন, কাগজের যে ফুল তৈরি করতে খরচ সর্বোচ্চ ৫ টাকা, সেটা অনায়েশেই ১৫টায় বিক্রি করা যায়। বাড়ির লোকজনই তৈরি করে এ ফুল। জেলা শহরের মুড়িভাজা বিক্রেতা আব্দুস সলামের বাড়ি ফার্মপাড়ায়। তিনি বললেন, ২শ টাকা পুঁজি হলে কি হবে। লাভ প্রতিদিন পুঁজির দ্বিগুণ। অবশ্য আব্দুস সালাম ৩ কন্যার মধ্যে দু কন্যাকে অল্প বয়সেই বিয়ের আসনে বসিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি নিজেই বলেছেন, অভাবে নয়, মেয়ে দুটিই দেখতে শুনতে সুন্দর ছিলো। পাড়ার বখাটেদের উৎপাতে কন্যাদের বিয়ে দিতে আর দেরি করা গেলো না। তাই ভালো পাত্র দেখে ক্লাস এইটে পড়া মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। ছোট মেয়ের বয়স এখন ৪ বছর।
রাস্তার পাশে বসে ধুপি কিম্বা পেঁয়াজো চপ বিক্রেতা, ভ্যানে করে মগজ ভোনা বা চটপটি কিম্বা বাদাম-ছোলা ভাজা বিক্রি হোক, কাজ তো আর ছোট নয়। স্বল্পপুঁজির ব্যবসা। পিছু লোকে কিছু বলে ভেবে যারা বিছানায় লুকিয়ে রাখে মুখ তাদের একদিন দিনমজুরি ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অন্যথায় পা বাড়াতে হয় অপরাধ জগতে। সে কারণে পরিকল্পিতভাবে কিছু করতে পারলে ভাগ্যের চাকা ঘোরতে কি বেশিদিন লাগে? যেমন লাগেনি পৌরকলেজপাড়ার ১০টি আলমসাধু মালিকের। শ্যালোইঞ্জিন চালিত এসব যান অবৈধ হলেও চলছে তো হরদম। প্রতিদিন আলমসাধু প্রতি ২শ টাকা করে ভাড়া। ফলে দিন গেলেই আয় ঘরে বসে ২ হাজার টাকা। সেটা কি একদিনে হয়েছে। ওই আলমসাধু কেনার আগে তাকে ভাজা বিক্রি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি সঞ্চয়ও করতে হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চুয়াডাঙ্গার প্রয়াত এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে চমৎকার একটি গল্প প্রচলিত আছে। শোনা যায়, অবিভক্ত বাংলা ছিলো তখন। ওই সময় মাঝে মাঝেই ওই ব্যবসায়ীকে ট্রেনযোগে কোলকতা-চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়ায় আসা যাওয়া করতে হতো। তখন ট্রেনের মাসিক হাকারি টিকেট ছিলো নামমাত্র মূল্যে। সেই টিকিটেই তিনি শুধু চলতেন না, কোলকাতা থেকে কমলা বা আপেল নিয়ে ঝুড়িতে করে ট্রেনে বিক্রি করতে করতে ফিরতেন চুয়াডাঙ্গা বা কুষ্টিয়ায়। বিক্রি করে পুঁজিই ঘোরাতেন না, তিনি লাভের টাকা গুণতেন হাসিমুখে। আর অবিক্রিত ফল? সেগুলো বাড়ির শিশুদের জন্য নিয়ে যেতেন বাড়িতে। এভাবেই নাকি তিনি সম্পদ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তিনি অর্থশালী অবাঙালি ব্যবসায়ী হলেও কোনো কাজকে ছোট করে দেখতেন না বলেই তাকে নিয়ে ওই গল্প। সত্যি হোক আর না হোক, গল্পটি অনেকের কাছেই শিক্ষণীয় হয়ে আছে।