স্টাফ রিপোর্টার: চলতি অর্থবছরে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বরাদ্দ ছিলো ৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা। কিন্তু যথাসময়ে ব্যয় করতে না পারায় এখন ফেরত দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। একইভাবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নির্মাণাধীন মেট্রোরেল এবং মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প কর্তৃপক্ষও বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য ফেরত যাচ্ছে আরও ২ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এই ৩টি প্রকল্প থেকেই ফেরত দিতে হচ্ছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থাকে হতাশাজনক মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবচেয়ে আলোচিত এসব প্রকল্পে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করতে না পারা প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ক্রটি। এতে প্রকল্পের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। জানা গেছে, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়মিত তদারকি করে থাকে। কিন্তু এত সতর্কতা সত্ত্বেও প্রকল্পের শুরুতেই অর্থ ব্যয় করতে পারছে না প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এই ৩ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ছিলো ১০ হাজার ৬৫৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত) এসব প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫৮০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ব্যয় করতে না পারার আশংকায় সম্প্রতি মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বরাদ্দ কমানোর জন্য। এভাবে বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন শংকার মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম শনিবার বলেন, দক্ষ ও যোগ্য লোকের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন ছাড়াই এডিপিতে মোটা দাগে বরাদ্দ চাওয়া হয়। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না। এটা শৃঙ্খলার পরিপন্থী এবং প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ত্রুটি। পদ্মা সেতুসহ অন্য প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও হয়তো এটিই হয়েছে। তা না হলে বাস্তবায়নের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চললেও বড় অংকের বরাদ্দ কমাতে হচ্ছে কেন।
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এর কারণ উল্লেখ করেন না। তারা শুধু কোন প্রকল্পে বরাদ্দ কত কমবে বা বাড়বে সেটি উল্লেখ করে থাকে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, দেশের বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে সংশোধিত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের জন্য এডিপিতে বরাদ্দ ছিলো ৬ হাজার ২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী বাদ দেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৩৫২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে প্রকল্পটিতে চলতি অর্থবছরের যে বরাদ্দ ছিলো সেখান থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত (পাঁচ মাসে) ব্যয় হয়েছে এক হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ছিলো ৩৯ শতাংশ। বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করতে না পারায় কারণ জানতে শনিবার প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাকে পুরো বিষয়টি বলা হলেও তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
পরিকল্পনা বিভাগের সদ্য বিদায়ী সচিব তারিক-উল-ইসলাম বলেন, প্রথম কল নোটিশ অনুযায়ী সাধারণত বোঝা যায় না শেষ পর্যন্ত কত কমতে পারে। তবে দ্বিতীয় কল নোটিশ যখন দেয়া হবে তখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়। সুতরাং দ্বিতীয় কল নোটিশ পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে অপেক্ষা করা হয়।
এছাড়া ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (মেট্রোরেল) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ছিলো ২ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এর থেকে ১ হাজার ৪৪ কোটি ৪ লাখ টাকা বাদ দিয়ে মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে ব্যয় হয়েছে ১৬৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৭০৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা। গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মোফাজ্জল হোসেন জানান, মার্চ মাসে আরএডিপি তৈরি হবে। তখন চূড়ান্ত করা হবে কত কমবে। তবে শিগগিরই চারটি নতুন চুক্তি হবে। এসব চুক্তি হলে এর জন্য মবিলাইজেশন ফান্ড এবং চলমান চুক্তিগুলোর জন্য রানিং বিল পরিশোধ করতে অনেক টাকা লাগবে। সুতরাং এখনও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না কমবে কিনা। অপর মেগা প্রকল্প মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট থেকে ১ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা বাদ দেয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিলো ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এখন আরএডিপিতে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত বছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ব্যয় হয়েছে ১১৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর প্রকল্পের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৬৭৪ কোটি টাকা। মাতারবাড়ী বিদ্যুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে।