ঝুঁকি জেনেও অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদান বাড়ছে

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে অস্ত্রোপচারের (সিজার) মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বেড়েই চলছে। স্বাভাবিক ডেলিভারি কষ্টদায়ক হওয়ায় অনেক প্রসূতি মা-ই এই পদ্ধতিকে বেছে নিচ্ছেন। সিজারের কারণে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে তথ্য জানার পরও অনেকে এ পদ্ধতি বেছে নেন। আবার বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় সন্তান সম্ভাবা মাকে ঝুঁকি না নিয়ে ছুরি-চাকুর নিচে সেধে দেন। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ রকম কাটাছেড়া জন্মদান পদ্ধতিতে মায়ের শরীরে বিভিন্ন ধরনের অ্যানেসথেটিক বা চেতনা নাশক ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে অনেক সময় গর্ভনষ্ট, শিশুর প্রতিবন্ধিত্ব ঝুঁকিসহ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলে।
অস্ত্রোপচার জন্মদানের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে মহানগর মা ও শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মাদ মোশারফ হোসাইন বলেন, অনেক মেডিকেল ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়িক উদ্দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত অস্ত্রোপচার করে থাকে। এতে করে প্রসূতির শরীরে অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক জাতীয় মেডিসিন প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে মা ও নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। অস্ত্রোপচারে প্রসূতির এন্ডোমেটাইটিস বা ক্ষতস্থান ইনফেকশনের কারণে মায়ের জ্বর, পেটব্যথা, মাসিকের রাস্তায় অস্বাভাবিক নিঃসরণ হতে পারে। অ্যাম্বোসিস বা পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। সিজারের সময় অতিরিক্ত ক্ষরণ ও সিজার-পরবর্তী বুকে দুধ আসতেও দেরি হয়।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (ডিবিএইচএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালে ৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ১৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে শতকরা ২৩ ভাগ শিশুর অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে সেভ দ্য চিল্ড্রেনের কর্মশালায় জানানো হয়, দেশে শিক্ষিত ও অর্থবিত্ত পরিবারে সিজারের হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়া মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা ও মাতৃমৃত্যু জরিপ ২০১০-এর রিপোর্টে বলা হয়, শুধু ২০০৯ সালে ৪ লাখের বেশি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম নিয়েছে। যেটা ২০০১ সালের তুলনায় ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি।

২০১৫ সালে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচারে জন্মদান প্রায় ৮ গুণ বেড়েছে। শুধুমাত্র ২০১৩ সালে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি মা ভর্তি হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জন শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেয়। কিন্তু এদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ প্রসূতিকে নরমাল ডেলিভারি করা যেত।

জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছর মোট ১২ থেকে ১৩ হাজার শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বা প্রায় ৬ হাজারের মতো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। আরেক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিকেলে ৬০ শতাংশ ও বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ৮০ ভাগ নবজাতক সিজারের মাধমে জন্ম নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর মোহাম্মাদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিস ও ট্রেনিং সেন্টারে ১ হাজার ৫৯ জন শিশু নরমাল ডেলিভারি হয়েছে আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ২ হাজার ৭৫০ জন নবজাতক জন্ম নিয়েছে। সাধারণত সিজার বা সি-সেকশন মা ও শিশুর জীবন রক্ষায় কার্যকর মনে হলেও অদূর ভবিষ্যতের জন্য এটা মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এর মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিও কখনো বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং সিজারিয়ান শিশু বেশি পরিমাণে ইনফেকশনের ঝুঁকিতে থাকে। আর এই মাধ্যমে সাধারণত ২৫ শতাংশ নবজাতকের নির্ধারিত সময়ের (২৫ থেকে ২৮ দিন) আগেই জন্ম হয়ে থাকে যেটা ইনফেকশনের বড় কারণ হতে পারে। এতে প্রথম ৩ দিন নবজাতকের ট্রান্সমিয়েন্ট ট্যাকিপি্নয়া বা ঘনঘন শ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি সিজারিয়ান শিশুর বস্নাড ইনফেকশনের হার বেশি বলে জন্ডিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারিতে শিশু মা থেকে কিছু অণুজীবাণু পেয়ে থাকে যা বাচ্চার রোগ প্রতিরোধে সহয়তা করে। কিন্তু সি-সেকশনের শিশু হাসপাতালের কাঁচি ছুড়ির অণুজীবাণু পায় যেটা তার জন্য খুবই মারাত্মক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা শিশু হাসপাতালের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, রাজধানী ও বিভাগীয় শহর ছাড়াও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল-ক্লিনিকে আয়ের প্রধান উৎস এটা। তিনি বলেন, একটা ভালোমানের ক্লিনিকে প্রতি সিজার বাবদ ১৫ থেকে ৫০ হাজার বা তার চেয়েও বেশি টাকা নেয়া হয়। যেখানে সরকারি হাসপাতালে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় এসব সেবা পাওয়া সম্ভব। তিনি মনে করেন, প্রসূতির মাত্রাতিরিক্ত সমস্যার কারণে ১০ থেকে ১২ শতাংশ শিশুর জন্মের সময় সিজারের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু দঃখের বিষয় অনেক প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতেই শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত সিজার করা হয়।

এ বিষয়ে মোহাম্মাদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিস ও ট্রেনিং সেন্টার হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মনিরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, সন্তান প্রসবজনিত জটিলতার কারণেই অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু স্বাভাবিক জন্মদানে যদি লেবার বেশি থাকে সেক্ষেত্রে ধাত্রী এক্সপার্ট না হলে মা ও শিশুর বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া একলাম্পশিয়া বা খিচুনি কষ্ট ও লেবার অবস্ট্রাক্টে প্রসূতি ও নবজাতকের চাপজনিত ঝুঁকির সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে। সময়মতো এনেসথেশিয়ার অভাবে মায়ের অ্যামেনিয়া বা রক্তস্বল্পতা ও কার্ডিয়াক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই মায়ের লেবার সমস্যা হলে, হার্টবিট বেড়ে গেলে, জন্ডিস বা ডায়াবেটিস থাকলে সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। তবে নিয়ম হলো ব্যথা ওঠার পরে সরাসরি সিজার না করে সর্ব প্রথম রোগীকে রেফারেল সেন্টারে নরমাল ডেলিভারির ট্রায়াল দেয়া। এরপরও কেউ সিজার করতে চাইলে মা ও বাচ্চার পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মূলত এই পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব সহজ ও বাচ্চার স্ট্রেসজনিত কোনো ক্ষতি হয় না। তাই অনেক অভিভাবকই স্বাভাবিক ডেলিভারিতে কষ্টের বিষয় চিন্তা করেন এবং ঝুঁকি না নিয়ে ফ্যাসিলিটির বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেন।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তাওফিকা হোসাইন  বলেন, নরমাল ডেলিভারি সবসময়ই ভালো। খুব বেশি ক্ষতির কারণ না থাকলে এটা না করাই উচিত। কিন্তু অনেক সময় প্রসূতির মুমূর্ষু অবস্থা বা মৃত্যুর আশঙ্কা থাকলে এটা জরুরি হয়ে পরে। তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় থাকে না। তবে এর কিছু সমস্যাও আছে যেমন এনেসথেশিয়া ডিউরিং টাইম ও পোস্ট অপারেটিভ টাইমে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই পদ্ধতিতে বেশি সন্তান নেয়া যায় না। তাই অস্ত্রোপচার দরকার হলে প্রয়োজনীয় মেডিসিন, বস্নাড ও অ্যানেসথেশিয়া উপকরণ থাকতে হবে। সন্তান প্রসব পূর্বে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে করা উচিত। আবার কিছু সুবিধাও আছে যেমন সিজারিয়ান সিস্টেমে জন্ম নেয়া শিশুর স্ট্রেস ঝুঁকি কম থাকে বলে মা বা নবজাতকের কষ্ট কম হয়।

এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, জার্মানির মিউনিখ শহরে জন্ম নেয়া ৮৬৫ জন শিশুর ওপর এক জরিপ চালিয়ে দেখা যায় সি-সেকশনে জন্ম (সিজারিয়ান) নেয়া শিশু যারা জন্মের ৪ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করেছে। ১ বছর বয়সে এসে দেখা যায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়া শিশুদের চেয়ে তাদের ডায়রিয়া আক্রান্তের ঝুঁকি ৪৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া নরমাল জন্ম নেয়া বেবির তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতি সন্তান জন্ম নেয়া নবজাতকের প্রথম ২৮ দিনে মৃত্যুহার প্রায় ৩ গুণ বেশি। শিকাগোর ডা. এলিউট এম লেভিন ও সহযোগী গবেষকদের মতে সি-সেকশনে জন্ম নেয়া শিশুর প্রথমিক পালমোনারি উচ্চ রক্তচাপ ৫ গুণ বেশি। এমনকি প্রতি হাজারে প্রায় ৪ জন শিশুর ক্ষেত্রে এমন ঘটে যেখানে নরমাল শিশুদের প্রতি হাজারে এই হার ০ দশমিক ৮। ২০০১ সালে ফিনল্যান্ডের জার্নাল অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজি শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় যে সিজারিয়ান ডেলিভারি শিশুদের অ্যাজমা রোগের হার অনেকগুণ বেশি। আর নিউরোসাইন্স চিকিৎসকদের মতে এসব শিশু সিজোফ্রেনিয়াসহ গুরুতর মানসিক রোগে ভুগতে পারে।