ইসলাম রকিব: দিন মাস মনে না থাকলেও সালটা ছিলো ১৯৩১। চুয়াডাঙ্গা শহরতলীর দৌলাতদিয়াড় সরদারপাড়ার উত্তরপ্রান্তে সাদেক আলী ম-লের ঘর আলো করে আসে যে নকবজাতক, তার নাম রাখা হয় কবির উদ্দিন। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার মধ্যে যে বিষয়টি ফুটে উঠতে থাকে, তাহলো ফুটবল খেলা। বিষয়টি দেখে নীরব থাকেননি বাবা। বইয়ের পাশাপাশি ফুটবলও কিনে দিতে শুরু করেন তিনি।
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়লে কী হবে, তার ডাক পড়তে শুরু করে আশপাশের গ্রামে। শহরেও। এ বিষয়ে তিনি বললেন, তখনও মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর কোনো ব্রিজ নির্মাণ হয়নি। নদী সাঁতরে শহরে খেলতে যেতে হতো। মা বার বার বারণ করলেও বাবার উৎসাহে ফুটবলকে আরও আপন করে নিতে শুরু করি। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গ-ি পেরোলে পা পড়ে চুয়াডাঙ্গার ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের আঙিনায়। এরপর আর কে ঠেকায়। খেলার সরঞ্জাম ও খেলায় অংশ নেয়ার ব্যাপারে আর বেগ পেতে হয়নি। বাবা বলতেন, নিজেকে অক্ষত রেখে খেলাধুলা করবি।
কবির উদ্দীন বর্তমানে শয্যাগত। তারপরও চমৎকার স্মৃতিশক্তি নিয়ে অনারগল বলে গেলেন শৈশব থেকে এ যাবত কালের জীবনচিত্র। ফুটবল খেলায় ওস্তাদ কে? বলেন, আমার জীবনের তিনজন ওস্তাদের কথা মনে আছে। মরণের আগ পর্যন্ত তাদের আমি ভুলবো না। আমার ওস্তাদরা আজ বেঁচে নেই। তারপরও তাদেরকে ভুলতে পারি না। তারা হলেন- হাতেখড়ি মুসা মিয়ার কাছে। দ্বিতীয়ত ভি.জে স্কুলের রফাতুল্লাহ প-িত সাহেবের নিকট থেকে নিই শিক্ষা। এরপর পেয়েছি হায়দার আলী জোয়ার্দ্দারের মতো দক্ষ মানুষের অনুপ্রেরণা। যার নামে চুয়াডাঙ্গা পুরাতন স্টেডিয়াম ‘হায়দার আলী প্যাভেলিয়ন’ নামকরণ করা হয়েছে।
ফুটবল খেলার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নের সময় টাউন ক্লাবে ভর্তি হই। সে সময় ভি.জে স্কুলের থেকে ইন্টার স্কুল জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইন্টার ডিস্ট্রিক খেলতে ঢাকায় গিয়েছি। অবশ্য ১৯৫৮-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ইন্টার ডিস্ট্রিকে খেলতে ঢাকায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সে সময় পাকিস্তানের করাচি কির্কাস ও করাচি কেয়ামারী দুটি টিমের সাথে আমাদের খেলা হয়। সেখানে একটি ম্যাচে আমরা বিজয়ী হই ও একটিতে পরাজিত হই। ফুটবল খেলার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, একটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে দরবেশপুর মাঠে গোকুলখালীর হয়ে আমরা খেলতে গিয়েছি। প্রতিপক্ষ টিম ছিলো কয়রাডাঙ্গা। আমরা ২-০ গোলে জিতে আছি। তৃতীয় গোল করার জন্য আমি বল নিয়ে গোল বারের কাছাকাছি চলে এসেছি। এ সময় সিরাজ নামের এক খেলোয়াড় আমার পায়ের ওপর লাফিয়ে পড়লে ডান পা ভেঙে যায়। সেখানেই বেজে ছিলো খেলার শেষ বাঁশি। আমাকে টাউন ক্লাব চিকিৎসার খরচ দিয়েছিলো। সেরে উঠলে আবারও মাঠে ফুটবল খেলেছি। তবে সাবধানে।
সমসাময়িক ফুটবল খেলোয়াড়দের কথা জানতে চাইলে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন কবির। ক্রাসে ভরদিয়ে নিজেকে সংবরণ করে বলেন, আমার সময়ের কেউ আজ বেঁচে নেই। আমি হতভাগা কবির শুধু বেঁচে আছি। আমার সাথে যারা ফুটবল খেলতো তাদের মধ্যে সর্বশেষ মারা যান সাফায়েতুল ইসলাম সাফা মিয়া ও ইসলাম উদ্দিন জোয়ার্দ্দার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আমি ফুটবল খেলেছি। তবে আগের মতো জোর পেতাম না।
বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার ফুটবলের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গার ফুটবল নিয়ে আজ আর কেউ ভাবতে চান না। বেশ কিছুদিন আগে ছেলুন মিয়ার ছোট ভাই টোটন পৌরসভায় ডেকেছিলেন। অনেক কষ্ট করে সে সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, ফুটবলকে উজ্জীবিত করতে হলে পুরাতন ফুটবলারদের মাঠে ডাকতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সাথে নিয়ে তাদের মধ্যে খেলার আগ্রহ বাড়াতে হবে। তবে ক্রিকেটের জৌলুসে ফুটবল যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে ফুটবল সংগঠকদের এগিয়ে আসতে হবে।
ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৫১ মেট্টিক পাস করার পর রেজিস্ট্রি অফিসের কপিস্ট হিসেবে যোগদান করে চাকরি জীবন শুরু করি। এরপর বেসরকারি সমবায় ব্যাংক, পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেছি। এরকিছু দিন পর সরকারি সমবায় ব্যাংকের সহকারী পরিদর্শক হিসেবে বরিশালে যোগদান করি। এ সময়টুকু ফুটবল খেলায় বেশ কিছুটা ভাটা পড়ে। পরে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চুয়াডাঙ্গা সমবায় ব্যাংকে যোগদান করি এবং ওখান থেকেই অবসর গ্রহণ করি। আমার দু ছেলে ও এক মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে শরিফ উদ্দিন ব্র্যাকের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ও ছোট ছেলে শাহাবদ্দিন তথ্য মন্ত্রাণালয়ে চাকরি করে এবং সে কণ্ঠশিল্পী। আমার একমাত্র মেয়ে মাজেদা খাতুন বেলী। ছেলেমেয়েরা সবাই এখন যার যার মতো সংসার করছে। আমি ও আমার সহধর্মিণী চুয়াডাঙ্গা দৌলাতদিয়াড়স্থ নিজ বাড়িতে এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনি। পরিশেষে তিনি চুয়াডাঙ্গার ফুটবলারদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা এগিয়ে যাও, মাঠে থাকো। কেউ না কেউ তোমাদের পাশে থাকবে।