জয়রামপুরে পাথর ভর্তি ট্রাক চাপায় মা ও শিশু সন্তানসহ নিহত ৩ : উত্তেজিত জনতার আগুন

দামুড়হুদা থেকে একই মোটরসাইকেলে ৪ জন আন্দুলবাড়িয়ায় যাওয়ার পথে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার

দামুড়হুদা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার জয়রামপুরে পাথর বোঝাই একটি ট্রাক চাপায় মা ও ছেলেসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া জেলা সদরের জাফরপুরে যাত্রীবাহী বাস ও আলমসাধুর মুখোমুখি সংঘর্ষে আরও ৭ জন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর সড়কে দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর শেখপাড়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- দামুড়হুদা দশমীপাড়ার জাকিরুল ইসলামের স্ত্রী নাসরিন খাতুন (২৮) ও তার সাত মাস বয়সী শিশুপুত্র নাজমুল ইসলাম নিবিড় ও নাসরিনের খালাতো দেবর মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের মোকাম আলীর ছেলে সাহেব আলী (৩৫)। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন নাসরিনের ভাই জাহিদুল ইসলাম (২৫)। দুর্ঘটনার পর পর উত্তেজিত জনতা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে দামুড়হুদা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদর হাসপাতালে পাঠায়। ঘাটক ট্রাকটি পুলিশ আটক করলেও ট্রাকের চালক পালিয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, ওই চারজন একটি মোটরসাইকেলে চেপে জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া থেকে দামুড়হুদায় যাচ্ছিলেন। দর্শনা রেলবন্দর থেকে পাথর বোঝাই করে শাহিন ট্রান্সপোর্টের একটি ট্রাক (ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-৯৫১০) পদ্মা সেতুর পাথরবাহী তিনটি ট্রাক তাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। জয়রামপুর শেখপাড়া এলাকায় পৌঁছালে মোটরসাইকেলটি পাথর বোঝাই ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে মোটরসাইকেল আরোহী ৪ জনই ট্রাকের নিচে পড়ে পিষ্ট হয়। ঘটনাস্থলেই সাহেব আলী ও শিশু নাজমুলের মৃত্যু হয়। বাকি দুজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নাসরিন খাতুনকে মৃত ঘোষণা করেন।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা সদরের দশমীপাড়ার মৃত জান মোহাম্মদের ছেলে জাকিরের স্ত্রী নাসরিন পারভীন তার ৭ মাস বয়সী শিশুসন্তান নিবিড়কে নিয়ে ছোট ভাই জাহিদ (২০) ও খালাতো দেবর মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের মোকাম আলীর ছেলে সাহেব আলীর সাথে গতকাল বিকেল ৪টার দিকে একই মোটরসাইকেলযোগে দামুড়হুদা থেকে পিতার বাড়ি জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-যশোর আঞ্চলিক সড়কের জয়রামপুর শেখপাড়ার হারেজের চায়ের দোকানের সামনে পৌছুলে বিপরীত দিক থেকে আসা পাথর ভর্তি একটি ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। নাসরিন, তার কোলে থাকা সাত মাসের শিশু সন্তান নিবিড় এবং মোটরসাইকেল চালক জাকিরের খালাতো ভাই সাহেব আলী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পথচারীরা মোটরসাইকেল আরোহী নিহত নাসরিনের ছোট ভাই জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে জাহিদকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। জাহিদুলকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আওলিয়ার রহমান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকায় নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সযোগে রওনা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহত তিনজনের লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়। পরে নিহত ওই তিনজনের লাশ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অনুমতি সাপেক্ষে নিহত তিনজনের মরদেহ দামুড়হুদায় নেয়া হয়। আজ শনিবার সকাল ১০টায় দামুড়হুদা পাইলট হাইস্কুল ফুটবল মাঠে জাকিরের নিহত স্ত্রী ও শিশুপুত্রের জানাজার নামাজ শেষে দশমী কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হবে বলে নিহতের পারিবারের লোকজন জানিয়েছেন। এছাড়া নিহত সাহেব আলীর লাশ আজ শনিবার তার নিজ গ্রাম মহাজনপুরে নেয়া হবে। দুপুরে জানাজা শেষে নিজ গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হতে পারে। আহত জাহিদ সদ্য নৌবাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন। তিনি আগামী ১ জানুয়ারী নৌবাহিনীতে যোগদান করার কথা ছিলো। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সাথে সাথে ঘটনাস্থলে পৌঁছান চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগার টগর। তিনি উদ্ধারকাজ তদারকি করেন।
দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি আবু জিহাদ জানান, ট্রাকটি পদ্মা সেতুর জন্য দর্শনা থেকে পাথর নিয়ে যাচ্ছিলো। ঘাতক ট্রাকটি আটক করা হয়েছে। তবে ট্রাকচালক পালিয়ে গেছে। এ ঘটনায় এ খনও পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলেও তিনি জানান। আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাহিদুলকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আওলিয়ার রহমান জানিয়েছেন তাকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর কথা বলা হয়েছে ।
এদিকে গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের জাফরপুরে যাত্রীবাহী বাস ও আলমসাধুর সংঘর্ষে ৭ জন আহত হয়েছেন। এদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। এ মধ্যে ৪ জনকে রেফার করা হয়েছে। আহতরা হলেন- চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কালোপোল গ্রামের ঠা-ু মল্লিকের ছেলে শহিদুল ইসলাম (৪০), চুয়াডাঙ্গা শান্তিপাড়ার নজরুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৩০), আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গড়গড়ির রতন ইসলামের স্ত্রী নার্গিস খাতুন (৩০), তার দুই সন্তান নাঈম (৯) ও ঋতু (৬) এবং আলমসাধুচালক নতুনভা-ারদহ গ্রামের মতিয়ার রহমানের ছেলে মামুন হোসেন (১৮)। আহতদের মধ্যে শহিদুল ইসলামকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে, জাহিদুল ইসলাম ও নাঈমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এবং আলমসাধুচালক মামুনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে রেফার করা হয়।
আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সদ্য নৌবাহিনী নিয়োগপ্রাপ্ত জাহিদ হোসেন আগামী ১ জানুয়ারি খুলনায় যোগদান করার কথা রয়েছে। সেই জাহিদ হোসেন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। তার চোখের সামনের বোন, ভাগ্নিসহ বোনের দেবর নিহত হয়েছেন। তার স্বপ্ন ছিলো আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে বিদায় নেবে। সে বিদায় নেয়া তার আর হলো না। সকল স্বপ্ন আশা আকাক্সক্ষা মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেলো। গতকাল শুক্রবার বিকালে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর কাঁঠালতলার অদূরে ট্রাক ও মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ আহত নিহত পরিবাবে চলছে শোকের মাতাম। দুর্ঘটনার খবর শুনে জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়ার ঘরামীপাড়ার শোকার্ত আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ি ও রাস্তার দু পাশে নারী-পুরুষ ভিড় জামায়। রাত সাড়ে ৭টার দিকে বাড়িতে গেলে কে আহত, কে নিহত হয়েছেন তা পরিরবারের সদস্যদের নিকট জানতে চাইলে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। উপন্থিত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে আরিফ হোসেন জানান, দামুড়হদার জাকির হোসেনের সাথে বড় বোন নাসরিন খাতুনের বিয়ে হয়েছে। দুলাভাই জাকির হোসেন বগুড়ায় একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোট ভাই জাহিদ হোসেন নৌবাহিনীর চাকরিতে আগামী ১ জানুয়ারি খুলনায়  যোগদান করবে। বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার জন্য সকালে দামুড়হুদা যায় বোনকে নিয়ে আসার জন্য। বিকালে বোন নাসরিন, সাত মাস বয়সী ভাগ্নি নিবিড় ও বোনের খালাতো দেবর সাহেব আলীকে সাথে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে বাড়ি ফিরার পথে তারা এ দুর্ঘটনার শিকার হয়। অপরদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বগুড়া থেকে জাকির হোসেন রওনা দেন।

Leave a comment