স্টাফ রিপোর্টার: শেষ উইকেটটি নিয়েই ডানা মেলে দিলেন আন্দ্রে রাসেল। মাঠের ভেতর-বাইরে থেকে ছুটে আসলো সতীর্থরা। সাকিব আল হাসান তখন ছুটছেন উল্টো দিকে। আগে তো দখলে নিতে হবে স্মরণীয় সাফল্যের একটি স্মারক! ছুটে গিয়ে তুলে নিলেন স্টাম্প। যোগ দিলেন সতীর্থদের উৎসবে। বৃত্ত বানিয়ে চললো আনন্দনৃত্য। ঢাকা ডায়নামাইটসের শিরোপা উৎসব। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই দলটি ছিলো টপ ফেভারিট। লম্বা আসরে টুকটাক হোঁচট খেলেও সময়মতো দেখিয়েছে শক্তিমত্তা। শেষ দিনটিতেও পড়লো সেটিরই প্রতিফলন। বিপিএলের ফাইনালকে একরকম একপেশে বানিয়ে জিতলো ঢাকা। বড় কোনো তারকা না নিয়েও উজ্জ্বীবিত ক্রিকেটে ফাইনালে উঠে আসা রাজশাহী কিংস পারলো না শেষ প্রতিবন্ধক পেরুতে। ঢাকার ১৫৯ রান তাড়ায় রাজশাহী করতে পারে ১০৩ রান। ড্যারেন স্যামির দল হেরেছে ৫৬ রানে। বিপিএলের প্রথম দুই আসরেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো ঢাকা। তবে সেটি ছিলো ভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স। এক বছর বিরতির পর গত আসরে শিরোপা জেতে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। এবার ডায়নামাইটস আবার ট্রফি ফেরালো ঢাকায়। প্রথম তিন আসরে চ্যাম্পিয়ন ভিন্ন দুটি দল হলেও অধিনায়ক ছিলেন একজনই। তিনবারই ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। এবারই প্রথম অন্য কোনো অধিনায়ক পেলেন শিরোপার স্বাদ, সাকিব আল হাসান! ১৬০ রান তাড়ায় রাজশাহী পেছনে পড়ে যায় প্রথম ১০ ওভারেই। আবু জায়েদের স্লোয়ারে নুরুল হাসান ফেরেন শুরুতেই। মুমিনুল হক ও সাব্বির রহমান দ্বিতীয় উইকেটে ৪৭ রানের জুটি গড়তে বল খেলেন ৪৩টি। যখন রানরেট বাড়ানোর সময়, তখন বিদায় নেন দুজনই। মেহেদী মারুফের সরাসরি থ্রোতে রান আউট সাব্বির (২২ বলে ২৬)। পরের ওভারে আম্পায়ারের বাজে সিদ্ধান্তে সাকিবের বলে এলবিডাব্লিউ মুমিনুল (৩০ বলে ২৭)। ১১ ওভার শেষে রান ৩ উইকেটে ৬৮। খানিক পর জেমস ফ্র্যাঙ্কলিনও যখন বিদায় নিলেন, রাজশাহীর চাই তখন ওভার প্রতি ১২ রান! ড্যারেন স্যামি ছিলেন বলে তখনও খানিকটা ছিলো রাজশাহীর আশা। সাকিবকে মাথার ওপর দিয়ে উড়িয়ে আশার পালে খানিকটা হাওয়া জুগিয়েছিলেনও তিনি। পরের বলেই অসাধারণ এক আর্মারে স্যামিকে বোল্ড করেন সাকিব। রাজশাহীর আশার সমাপ্তি ওখানেই, ঢাকার শেষ বাধা! প্রাথমিক পর্বের দুই ম্যাচে ঢাকাকে হারানোর নায়ক সামিত প্যাটেল ৪ রানে জীবন পেয়েও করতে পেরেছেন ১৭। এরপর ছিলো কেবল শেষের অপেক্ষা। ডোয়াইন ব্রাভোর থ্রো কনুইয়ে লেগে কেসরিক উইলিয়ামস আহত হয়ে মাঠ ছাড়ার পর আর ১ রান যোগ করতে পারে রাজশাহী। ম্যাচের প্রথম ভাগে ঢাকার তারকাবহুল ব্যাটিং লাইন আপে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি কেউ। তবে শুরুতে এভিন লুইস, শেষে কুমার সাঙ্গাকারা আর অন্যদের টুকটাক অবদানে ঠিকই তুলতে পারে তারা চ্যালেঞ্জিং স্কোর। প্রথম ওভারে কেসরিক উইলিয়ামস নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ঢাকার দুই ওপেনারকে। পাঁজর তাক করা বাউন্সার কোনোরকমে সামলান এভিন লুইস। মেহেদি মারুফের হেলমেট কাঁপিয়ে বল চলে যায় বাউন্ডারিতে। পরের বলেই মারুফের ব্যাট ছুঁয়ে আসা বল স্লিপে লাফ দিয়েও হাতে জমাতে পারেননি ড্যারেন স্যামি। তবে জুটি ভাঙে স্পিনে। আরও একবার প্রথম ওভারেই দলকে উইকেট এনে দেন মেহেদি হাসান মিরাজ। পয়েন্টে উইলিয়ামসের হাতে ক্যাচ দেন মেহেদি মারুফ। প্রথম ওভারে উইকেট পান আরেক অফ স্পিনার আফিফ হোসেনও। ক্যাচ দিয়ে বেঁচে গিয়েও এক বল পরই দৃষ্টিকটু ভাবে স্টাম্পড হন নাসির হোসেন। বল হাতে নিয়ে প্রথম বলেই মোসাদ্দেক হোসেনকে ফেরান ড্যারেন স্যামি।
৮ ওভার শেষে ঢাকার রান ছিল ৩ উইকটে ৫৪। লুইস বোধহয় ভাবলেন, এবার রান রেটে দম দেয়া দরকার! স্যামির এক ওভারে এলো তিন বাউন্ডারি, আফিফের টানা তিন বলে তিনটি। ১০ ওভার শেষে রান রেট গেল আট ছাড়িয়ে! এবারও রাজশাহীর আশীর্বাদ হয়ে আসে অধিনায়ক স্যামির বোলিং পরিবর্তন। আক্রমণে ফিরে প্রথম বলেই লুইসকে ফেরান ফরহাদ রেজা। লেগ স্টাম্পের বেশ বাইরের বল সোজা শর্ট ফাইন লেগে উইলিয়ামসের হাতে তুলে দেন লুইস (৩১ বলে ৪৫)! ডোয়াইন ব্রাভো, আন্দ্রে রাসেলরা পারেননি ঝড় তুলতে। বিস্ময়করভাবে সাকিব নামেন আটে। তবে পারেননি সময়ের দাবি মেটাতে। ভরসা তখন কেবল সাঙ্গাকারা। প্রত্যাশার প্রতিদান দিয়েছেন শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি। দলকে টেনে নিয়ে শেষ ওভারে আউট হয়েছেন ৩৩ বলে ৩৬ করে। শেষ দিকে মহামূল্য দুটি চার এসেছে সানজামুলের বলে। শেষ ৪ ওভারে ঢাকা তোলে ৪৪ রান। ব্যাটিং উইকেটে লক্ষ্যটা খুব কঠিন নয়। তবে ফাইনালের চাপে আর ঢাকার মতো বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ১৬০ রানও হয়ে যায় ১৮০! রাজশাহী শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়লো সেই চাপেই। ম্যাচ শেষে রাজশাহীর ক্রিকেটাররা যখন নির্বাক দাঁড়িয়ে মাঠের বাইরে, ঢাকার ক্রিকেটাররা তখন দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছে মাঠ প্রদক্ষিণ করে। খানিক পর মাঠের এক প্রান্তে ডিজে মঞ্চে উঠে ব্রাভো হাতে তুলে নিলেন মাইক্রোফোন, গ্যালারি মাতালেন তার চ্যাম্পিয়ন গানে। ঢাকার উৎসব যেন শেষ হওয়ার নয়। রেশ থেকে যাবে হয়তো আরও অনেকটা সময়! সংক্ষিপ্ত স্কোর: ঢাকা ডায়নামাইটস: ২০ ওভারে ১৫৯/৯ (মারুফ ৮, লুইস ৪৫, নাসির ৫, মোসাদ্দেক ৫, সাঙ্গাকারা ৩৬, ব্রাভো ১৩, রাসেল ৮, সাকিব ১২, আলাউদ্দিন ১, সানজামুল ১২*, আবু জায়েদ ০*; উইলিয়ামস ১/৩৬, ফরহাদ ৩/২৮, মিরাজ ১/২২, আফিফ ১/২৩, স্যামি ১/২২, নাজমুল ০/১৩ প্যাটেল ১/৮)। রাজশাহী কিংস: ১৭.৪ ওভারে ১০৩ (নুরুল ৮, মুমিনুল ২৭, সাব্বির ২৬, প্যাটেল ১৭, ফ্র্যাঙ্কলিন ৫, স্যামি ৬, আফিফ ৪* , মিরাজ ১, ফরহাদ ২, উইলিয়ামস ৪ (আহত অবসর), নাজমুল ১; আবু জায়েদ ২/১২, রাসেল ১/২১, সাকিব ২/৩০, ব্রাভো ১/২০, সানজামুল ২/১৭)। ফল: ঢাকা ডায়নামাইটস ৫৬ রানে জয়ী। ম্যান অব দ্য ম্যাচ: কুমার সাঙ্গাকারা (ঢাকা ডায়নামাইটস)। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট: মাহমুদল্লাহ (খুলনা টাইটানস)।