আলাদীনের আশ্চার্য প্রদীপে উল্টো ঘর্ষনের খেসারত দিচ্ছে শুকুর

যে মেটেরি মেলা এনে দেয় সৌভাগ্যের চাবি, সেই মেলায় ম্লান করলো ভাবমূর্তি

কামরুজ্জামান বেল্টু: উত্থানটা যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে যাওয়ার মতোই। পরিবর্তীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষভাগে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবদার হোসনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিতুদহ বিশ্বাসপাড়ার বাসিন্দা শুকুর আলী মোল্লা। এরপর গড়াইটুপির অম্রবুচি মেলা পরিচালনার মূল দায়িত্ব পেয়ে যান তিনি। ব্যাস। আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। যদিও ওই মেলা চালানোর মাত্রাতিরিক্ত লোভ তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে পতনের তলানিতে। গত ১২ নভেম্বর গ্রেফতারের পরদিন থেকে তিনি রয়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলহাজতে।

রাতারাতি ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ফেলা শুকুর আলী মোল্লা ওরফে আব্দুস শুকুর কয়েক দিনের মধ্যেই যেমন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান, তেমনই তার পাশে ভিড়তে শুরু করেন এলাকার নেতাকর্মীদের অনেকে। মেলাকেন্দ্রিক তোষামোদকারীও ঘুরঘুর করতে থাকে সাফারিপরা লম্বা চওড়া শ্যামা বর্ণের মানুষটার চারপাশে। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বেশ ক’জনকে চাকরি দিয়েও আলোচনায় উঠে আসেন। অনেকেরই চাকরি দেয়ার নিশ্চয়তাও দেন। তিতুদহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে তিনিই শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন। এরই মাঝে ব্যাচারি উচ্চ আদালতের কাগজ জাল করে চুয়াডাঙ্গা পুলিশের সাথে প্রতারণার অভিযোগে আনীত মামলার আসামি হন। রাতারাতি যার অবস্থান উঠতে থাকে উঁচুতে, তিনি যেন আছড়ে পড়েন মাটিতে। যদিও তার মাসহ নিকজনেরা বলেছেন, শুকুর ষড়যন্ত্রের শিকার। কেউ কেউ বলেছেন, যারা ওর কাছে থেকেছে, সুবিধা নিয়েছে তারাই বিভ্রান্ত করে বাড়তি সুবিধা নিতে চেয়েছে, তারাই আবার গোপন তথ্য ফাঁস করেছে।

শুকুর আলী তিতুদহ বিশ্বাসপাড়ার মৃত মকবুল বিশ্বাসের নাতি। পিতার বাড়ি কোটচাঁদপুরের দয়ারাম গ্রামে। তার বয়স যখন এক মাস তখন তাকে নিয়ে তার মা রোকেয়া বেগম তিতুদহ বিশ্বাসপাড়ায় ফিরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন কী পার হতে পারেননি তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শুকুর যে দান দক্ষিণা দেয়ায় সিদ্ধহস্ত, তা নিয়ে গ্রামের তেমন কারোরই দ্বিমত নেই। আপন দু বোনকে তিনি বানিয়েছেন দু সতীন। পাশাপাশি দুটি বাড়ি। দোতলা টাইলসে মোড়ানো ভবনে প্রথম স্ত্রী, আর পাশের একতলায় দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন। নানাবাড়ি বেড়ে ওঠা শুকুর কৈশোরে তার সেজ মামা আবু তালেবের সাথে হাটে হাটে কাঁচামাল তথা তরিতরকারি বিক্রি করতে শুরু করেন। কিছুদিন তিনি এলাকার হাটের খাজনা আদায়কারীর দায়িত্বও পালন করেন। বিএনপি করতে গিয়ে গ্রুপিঙের শিকার হয়ে নির‌্যাতনও ভাগ্যে জোটে। এরপরই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাবেক চেয়ারম্যান সাবদার হোসেনের হাতে হাত দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সক্রিয় হওয়া। মেলা অব্যাহত রাখতে উচ্চ আদালতের কাগজপত্র জাল করে পুলিশের কাছে ডাকযোগে প্রেরণই কাল হয়ে দাঁড়ায়। গ্রেফতার হলে এলাকাবাসীর মুখে মুখে একটি বিষয় ঘুরে ফিরে উঠে আসে, যে মেলা ওকে অর্থশালী করলো, সেই মেলাই ওর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। হায়রে কপাল!

স্থানীয়দের অনেকেই চা দোকানে বসে শুকুরের উত্থাপন-পতন নিয়ে নানা মন্তব্যে মশগুল থাকেন। গতকাল এক চা দোকানে বসে শুকুর আলী সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, ৭-৮ বছর আগে তিতুদহ ফাঁড়ির এক পুলিশ কনস্টেবলের নিকট থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে মেলার মাঠ ডাকে। সেই টাকা ফেঁপে ফুলে বেড়ে দাঁড়ায় কয়েকগুণে। দান দাক্ষিণ্য দেখে সকলেই বলতে থাকেন আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে গেছে শুকুর। কয়েক বছর শুকুর সেই প্রদীপ সোজাই ঘষেছে। সে কারণে দৈত্যের বদৌলতে তার কাছ থেকে মেলা নিতে পারেননি কেউ। গতবার সেই প্রদীপে বোধ হয় ভুল দিকে ঘষেছে। তা না হলে কি মেলা হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়। চড়ামূল্যে মেলা ডেকে বেচারা প্রদীপের সেই দৈত্যের উল্টো পাল্টা বোঝাতে গিয়ে সব হারিয়েছে।

প্রসঙ্গত, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের তিতুদহ ইউনিনের গড়াইটুপি অম্রবুচি মেলা প্রতিবছর ৭ আষাঢ় বা ২২ জুন শুরু হয়ে সাত দিন চলার কথা। গতবার পবিত্র রমজানের কারণে মেলা উদ্বোধন করা হয় ১২ আগস্ট। জেলা প্রশাসনের অনুমোদনে চলে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত। দ্বিতীয় দফায় মেলার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও আইন এসে সামনে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদর ইউনিটের তত্ত্বাবধানে মেলা চালানোর অনুমোদন মিললেও মুক্তিযোদ্ধাদের তরফে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। তারপরও চলতে থাকে মেলা। বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। একপর‌্যায়ে ঘোষণা দেয়া হয় উচ্চ আদালত মেলা চালানোর আদেশ দিয়েছেন। এ ঘোষণায় মেলা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি উচ্চ আদালতের কিছু ভুয়া কাগজপত্র পুলিশের কাছে প্রেরণ করা হয়। তা যাচাই করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রতারণার অভিনব কৌশলের চিত্র। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এ মামলায় গত ১২ নভেম্বর শুকুর আলীকে গ্রেফতার করা হয়।