মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরলেন খালেদা জিয়া

স্টাফ রিপোর্টার: দুই বছর এক মাস ১৬ দিন পর কারামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল বুধবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউ থেকে তিনি কারামুক্তি লাভ করেন। গত মঙ্গলবার মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি ঘোষণা করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের। এরপর আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দারের জিম্মায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর ভিড় আর সেøাগানের মধ্যে গুলশানের ভাড়া বাড়ি ফিরোজায় পৌঁছান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। নেতাকর্মীদের প্রচ- ভিড় সামলানোর জন্য দুই দফায় লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে এরপরও তার গাড়ি বহরের সঙ্গে কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী ছিলেন।
হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময়ে খালেদা জিয়ার পরনে ছিলো গোলাপি শাড়ি, চোখে সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার শুরু থেকে বাসায় যাওয়া পর্যন্ত তার বাম হাত কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিলো। ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাও ছিলেন ওই গাড়িতে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির সঙ্গে তার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমও মুক্ত হলেন। খালেদা জিয়ার দেখাশুনার জন্য তিনি শুরু থেকে কারাভ্যন্তরে ছিলেন।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদ- নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া। শুরুতে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হলেও গত বছর ১ এপ্রিল থেকে তাকে বিএসএমএমইউ’তে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিলো।
বিএনপিনেত্রীর দ-ের কার্যকারিতা স্থগিত করে মুক্তির আদেশের নথি প্রধানমন্ত্রীর দফতর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষের হাত ঘুরে বুধবার বিকেল পৌনে ৩টায় বিএসএমএমইউতে পৌঁছায়। এরপর প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে মুক্তি দেয়া হয় বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম জানান।
বিএসএমএমইউ পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক বলেন, খালেদা জিয়াকে বিকেল ৩টার দিকে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দিয়েছি। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোয়া ৪টার দিকে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।
মার্চের শুরুতে খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তি চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। তার তিন সপ্তাহ পর মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, সরকার নির্বাহী আদেশে দ-ের কার্যকারিতা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শর্ত হলো- এই সময়ে খালেদা জিয়াকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স বিবেচনায় মানবিক কারণে সরকার সদয় হয়ে দ-াদেশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে মঙ্গলবারেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। এরপর বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নথি যায় গণভবনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজেও সকালে গণভবনে যান। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর বুধবার নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসে। মন্ত্রণালয় তখন খালেদার মুক্তির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কারাগারে পাঠায়। এরপর খালেদা জিয়ার মুক্তির কাগজ নিয়ে একজন কারা কর্মকর্তা বিএসএমএমইউতে আসেন।
বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দারের ব্যক্তিগত অনুরোধ এবং তার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শর্ত সাপেক্ষে খালেদার সাজা ছয় মাসের জন্য মুক্তি সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদন করেন।
তিনি আরও বলেন, আইনের কিছু জটিলতা থাকায় দুটি শর্তে তাকে চিকিৎসা সেবার জন্য তার ছোট ভাইয়ের জিম্মায় ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এসময় তিনি ঢাকাস্থ নিজ বাসায় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করবেন। তবে দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ নিয়ে যেতে আগেই হাসপাতালের বাইরে এনে রাখা হয় তার গাড়িসহ ব্যক্তিগত নিরপত্তা বাহিনীর গাড়িবহর। তবে তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িতে চলতে অক্ষম হওয়ায় ছোট ভাইয়ের গাড়ি আনা হয়।
খালেদা জিয়াকে তার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিনা ইসলাম ও ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহিনা খান জামান আনতে যান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং খালেদা জিয়ার পরিবারের কয়েকজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কেবিন ব্লকে খালেদার মুক্তির অনুষ্ঠানিকতা শেষে নতুন একটি হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়া হয় ছয় তলার ৬২১ নম্বর কক্ষে।
মঙ্গলবার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হবে বলে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়ার পরপরই দলের নেতা-কর্মীরা বিএসএমএমইউর সামনে যান। গতকাল বুধবার দুপুর ১২টায় প্রথমে বিএনপিপন্থী চিকিৎসক সংগঠনের সদস্য ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আসতে শুরু করেন। বিএনপির পক্ষ থেকে দলের নেতাকর্মীদের হাসপাতালে না যাওয়ার নির্দেশনার পর কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী হাসপাতাল এলাকায় জড়ো হতে থাকেন।
করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ও জমায়েত না করার বিষয়ে বারবার হুঁশিয়ারির পরও বিএনপি নেতাকর্মীরা হাসপাতালে ভিড় করলে পরিস্থিতি কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ে। পুলিশ ও বিএনপি মহাসচিবকে হ্যান্ডমাইকে বারবার নেতাকর্মীদের হাসপাতাল চত্বর থেকে সরে যেতে অনুরোধ জানানো হয়।
খালেদা জিয়া বেরিয়ে আসার পরপরই হাসপাতালের ভেতরেই তার গাড়িকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের প্রচ- ভিড় জমে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নির্দেশনা রয়েছে তা কেউ মানতে চাইছিলেন না। তিনি বিএসএমএমইউ থেকে বের হওয়ার পর গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মোটরসাইকেলে এবং একটি বড় অংশ মানুষ হেঁটে এগোতে থাকে। কারও কারও হাতে ছিল হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড। নেতাকর্মীদের ভিড়ের কারণে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়ি ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা শুরু করে। এরপরও নেতাকর্মীরা তার গাড়িবহরের সঙ্গে ছিলেন।
বিকেল সোয়া ৫টায় ফিরোজাতে তাকে বহন করা গাড়িটি প্রবেশ করে। ফিরোজায় গাড়িটি পৌঁছার পর সেজ বোন সেলিমা ইসলাম, স্বামী রফিকুল ইসলাম, প্রয়াত সাইদ ইস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন ইস্কান্দার, জোবায়দা রহমানের বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দুসহ পরিবারের সদস্যরা তাকে ফুলের স্তবক দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। সেজ বোন ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর হাতে ভর করে তিনি গাড়ি থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসেন।
ফিরোজায় খালেদা জিয়ার গাড়ি পৌঁছুলে সেখানে কয়েক’শ নেত-কর্মী সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে সেøাগান দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এই সময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, ঢাকা সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
ফিরোজাতে খালেদা জিয়া প্রবেশের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ম্যাডাম অসুস্থ। তার সাথে কথা বলে এবং তার চিকিৎসকদের সাথে আলাপ কব তাকে বাসায় নিয়ে আসলাম। তার সুস্থতার বিষয়ে চিকিৎসকদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।