বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে আজ ব্যাপক উদ্দীপনায় পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। বৈশ্বিকভাবে এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘টেকসই ভোক্তা’ (সাসটেইনেবল কনজিউমার)। অন্তত দুটি দিক থেকে এটি খুবই তাৎপর্যময়। একদিকে ক্রেতাদের লাগামহীন ভোগপ্রবণতা যেন পরিবেশের বিপর্যয় না ঘটায়, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা অর্জনের আকাক্সক্ষা যেন পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে না তোলে। আর বাংলাদেশে এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার সুরক্ষিত হোক ভোক্তা অধিকার’। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী জাতীয় পর্যায়ে উদযাপনের এখন প্রস্তুতি চলছে। সেই বিবেচনায় উল্লিখিত প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্ববহ। তবে এমন এক পরিস্থিতিতে দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে, যখন ভোক্তাস্বার্থ অনেকটাই উপেক্ষিত। সংবিধানে ‘নিরাপদ পণ্য ও সেবা’ লাভের সুযোগকে একজন নাগরিকের অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ’-কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নকল ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পণ্যে বাজার সয়লাব। তাছাড়া পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের তারিখ না থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয় করা, বেশি দাম রাখা, ছাড়ের নামে প্রতারণা, জেনেশুনে ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা, এক পণ্যের দামদর ঠিক করে অন্য পণ্য গছিয়ে দেয়া এমন অনেক ঘটনা ঘটছে। বাজার ব্যবস্থায় নেই কার্যকর কোনো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। ফলে পণ্য ক্রয় বাবদ ভোক্তার বাড়তি অর্থ যেমন খরচ করতে হচ্ছে, তেমনি মিলছে না নিরাপদ ও মানসম্পন্ন পণ্যও। এর প্রতিকার জরুরি। ইতিবাচক বিষয় হলো, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধে ২০০৯ সালে সুনির্দিষ্ট একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। আর এ আইন বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠা করা হয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। আইন অনুযায়ী, কোনো পণ্যের মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের খুচরা বিক্রয়মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা না থাকা, পণ্য ও সেবার মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা, নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্য দাবি করা, ভেজাল পণ্য বিক্রি, ওজন পরিমাপক যন্ত্রে এবং দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতায় কারচুপি করা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন বাস্তবায়নে আমাদের দৃষ্টান্ত সন্তোষজনক নয়। দেশে অনেক ভালো ভালো আইন আছে। সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন আইনও প্রণীত হয়। অথচ সেগুলোর বাস্তবায়নে অগ্রগতি সামান্যই। তাই আইন থাকলে হবে না, ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সত্য যে সময়ান্তরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ আগের চেয়ে বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরে প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ আসছে। সংস্থাটি দ্রুততম সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করছে। তবে সংস্থাটির কার্যক্রম অনেকটা রাজধানীকেন্দ্রিক। অভিযোগ মূলত বেশি আসে ঢাকায়। এর বাইরে জেলা শহরগুলোয় এ ব্যাপারে তেমন সাড়া মিলছে না। এর পেছনে বড় কারণ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। সংস্থাটির লোকবল ঘাটতি আছে। এখনো কিছু জেলায় প্রতিষ্ঠানটির অফিস চালানোর মতো জনবল নেই। সংস্থাটিকে কার্যকর করতে হলে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভোক্তার অধিকারবিরোধী অপকর্ম প্রতিরোধে আরও বাড়াতে হবে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নজরদারি। তা না হলে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা সহজ হবে না।
এদিকে ভোক্তার দিক থেকেও কিছুটা সচেতনতার ঘাটতি বিদ্যমান। অনেকেই জানেন না যে পণ্য কিনে ঠকলে বা কোনো ধরনের প্রতারণার শিকার হলে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার তার আছে। কনজিউমারস ফোরাম পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, এখনো ৩৬ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ জানে না দেশে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণমূলক একটি আইন আছে। ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ মানুষ জানে না ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি অধিদফতর আছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে মোট জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদানের বিষয়টি বর্তমানে বেশ কাজ করছে। সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তাদের অভিযান ও জরিমানাবিষয়ক ঘটনাগুলো জনসমক্ষে আনছে। এখন বিশেষত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জানে যে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফোন করে বা অনলাইনে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মানুষের ভয় বা সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়নি। অধিকাংশ মানুষ এখনো মনে করে, অভিযোগ করে কিছু হয় না। এক্ষেত্রে ভোক্তা ও উৎপাদনকারী উভয় পক্ষেরই সচেতনতার অভাব আছে। সুতরাং ভোক্তা অধিকারবিষয়ক প্রচার-প্রচারণা আরো বাড়ানো দরকার। মনে রাখা চাই, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে হলে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ভোক্তাদের অধিকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের একক প্রচেষ্টায় পুরোপুরি ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা সম্ভব হবে না; সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে। সম্মিলিত প্রয়াসে ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাক এটিই প্রত্যাশা।