১২০ দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার : সাড়ে ৪ হাজার জনের মৃত্যু
স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবী পরিচিতি পেয়েছিলো ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ হিসেবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এক ভাইরাসের বিস্তার সেই পরিচিতি যেন মুছে দিয়েছে। তিন মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে প্রতিটি দেশ একে-অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতে সংক্রমিত দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে, বাতিল করা হচ্ছে ভিসাও। প্রতিটি দেশই নিজের সীমান্ত সুরক্ষায় জোর দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিচ্ছিন্নতা আগামী জুন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে।
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়। গত জানুয়ারির শেষদিকে তা ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করে। গতকাল পর্যন্ত বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ৬শ’র বেশি মানুষের। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার তিনশো ছাড়িয়ে গেছে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮ জনে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।
এই আলোচনার মধ্যে ইউরোপের ২৬ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এসব দেশে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবেন। বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ইউরোপ থেকে আগামী ৩০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ স্থগিত থাকবে। তবে এই কঠোর, কিন্তু প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাজ্যের জন্য কার্যকর হবে না। মার্কিন অর্থনীতির ওপর করোনা যে প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্ষুদ্র আকারের ব্যবসাগুলোকে ঋণ দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন ট্রাম্প। ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে নিউ ইয়র্ক শহরের উত্তরে নিউ রোচেলে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগ ও অ্যালার্জি বিষয়ক জাতীয় সংস্থার পরিচালক ডক্টর অ্যান্থনি ফওচি কংগ্রেসকে জানিয়েছেন যে- পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪৩টিতে করোনার সংক্রমণ হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটন ডিসি ও ২৩টি অঙ্গরাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর ইউরোপে থাকা মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে গণ আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। নতুন এই নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বব্যাপী এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। ইউরোপ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে সব দেশের নাগরিকদের ভিসা ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছে ভারত। বুধবার দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টুইট করে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
ভারতে এখন পর্যন্ত ৭৩ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত দিল্লির সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিনেমা হল বন্ধ। গতকাল টুইট করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, আগামী কয়েকদিনে তার কোনো মন্ত্রী বিদেশ সফরে যাবেন না। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আওতা বাড়িয়েছে সৌদি আরব। নতুন করে ইউরোপের সব দেশসহ ৩৯ দেশের নাগরিকদের ভ্রমণের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। এর আগে ১৯ দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো। এসব দেশে থাকা সৌদি নাগরিকদের দেশে ফিরতে ৭২ ঘণ্টার সময় দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও সৌদি আরবের সঙ্গে জর্ডানের স্থলসীমান্ত দিয়ে যাত্রী চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। তবে বাণিজ্যিক ও কার্গো চলাচল অব্যাহত থাকবে। নতুন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। কুয়েত আজ শুক্রবার থেকে সব ধরনের বাণিজ্যক যাত্রী ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ লেবানন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১১ দেশের নাগরিকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর আগে চীন, ইরান, ইতালি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের দেশটি ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ইতোমধ্যে উত্তর কোরিয়া সকল বিদেশি পর্যটকের জন্য তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। ইসরায়েল ছয় দেশ ও অঞ্চলের নাগরিগদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চীনা নাগরিক ও চীন ভ্রমণকারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় ৬০টি দেশ ও অঞ্চল।
অন্যদিকে, ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের নাগরিকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ। চীন থেকে ফ্লাইট বাতিল করেছে এয়ার কানাডা, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, লুফথানসা, লায়ন এয়ার, এয়ার সিউল, কাতার এয়ারওয়েজ, ইজিপ্টএয়ারসহ বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স কোম্পানি। এই করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে চীনের হুবেই প্রদেশকে বিবেচনা করা হয়। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা গতকাল আটজনে নেমে এসেছে। তবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে ইতালিতে। দেশটিতে ১২ হাজার ৪৬২ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৮২৭ জনের। এখন পর্যন্ত ইরানে ৩৫৪ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬৬ এবং ফ্রান্সে ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চীনা সরকারের সিনিয়র মেডিক্যাল অ্যাডভাইজার ঝং নানশান বলছেন, আগামী জুনের মধ্যে এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতে পারে। যদি সেক্ষেত্রে বিশ্বের দেশগুলো চীনের মতো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, এই ভাইরাসের কারণে দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়েছে, সেটা এই ভয়াবহ ভাইরাসে যথাযথ নিয়ন্ত্রণেই শেষ হতে পারে।