ব্যাংকে সুশাসনের অভাব : বাড়ছে খেলাপি ঋণের হার

স্টাফ রিপোর্টার: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সুশাসনের অভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণের হার। ফলে সরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও তা কমছে না। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হলেও তা ঋণ প্রবৃদ্ধিতে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সম্পদের (ঋণের ব্যবহার) সঠিক বণ্টন না হওয়াতেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক খাতের ওপর বিশ্বব্যাংকের তৈরি ‘ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের (এফএসএপি) প্রতিবেদনের খসড়ায় এমন মন্তব্য করা হয়েছে। খসড়াটি ওয়েবসাইটে প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি সংস্থাটির মিশন চিফ প্রধান মি. পিটরো এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংককে। সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এফএসএপির প্রতিবেদনের খসড়ায় আরও বলা হয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ হলেও বাস্তবে এটি আরও বেশি। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেশি থাকায় প্রকৃত খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের অধিক। এক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ ঋণের হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ, স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পুনর্তফসিলের অনাপত্তির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব বিবেচনায় অর্থনীতিতে ‘প্রবলেম অ্যাসেট’র পরিমাণ ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে একটি বৈঠক করে এর জবাব তৈরি করেছে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের প্রতিফলন ঘটেনি। তবে খেলাপি ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে মন্তব্য করেছে সেটি বাদ দিয়ে এফএসএপি রিপোর্ট প্রকাশ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এটি লিখিত আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সদ্য বিদায়ী প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। সেখানে অন্য ধরনের প্রভাব চলে আসে। যে কারণে ঋণখেলাপি হয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। পাশাপাশি ঋণেরও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না, যেখানে ঋণ প্রয়োজন সেখানে যাচ্ছে না, আবার যারা ঋণ পাচ্ছেন তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করছে না। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বজায় রাখা হয় না। আবার ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিকেও তাদের মনোযোগ কম। যতোটুকু মনোযোগ দেয়া দরকার তা দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি রয়েছে দক্ষতার অভাব। অন্যান্য টেকনিক্যাল সাইটেও খুব বেশি উন্নত নয়। যে কারণে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ করে মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে একদিকে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কর্পোরেট গভর্নেন্সের অভাব রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে মন্তব্য করেছে সেটি সত্য। খেলাপি ঋণের সমস্যা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নয়। এটি ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। সুশাসনের অভাব বলা হয়েছে কারণ এখন ব্যাংকের মালিক ও পরিচালকরা মিলেমিশে ঋণ নিচ্ছে। এক পরিচালক ঋণ নিচ্ছে অন্য ব্যাংকের পরিচালকের কাছ থেকে। তারা আবার ঋণ পরিশোধ করছে না। যে কারণে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এজন্য বিশ্বব্যাংক বলেছে, সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এর আগে বাংলাদেশের ঋণখেলাপি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে খেলাপি ঋণের হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষে। অর্থাৎ ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ভুটান এবং আফগানিস্তান। যাদের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯ এবং ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। আর চতুর্থ স্থানে আছে ভারত। তাদের হার হচ্ছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের হার পাকিস্তানে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, মালদ্বীপে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ ও শ্রীলংকায় হচ্ছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (ডিসেম্বর পর্যন্ত) হিসাবে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এটি গত জুনে ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত দশ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে চারগুণ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এই ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ৩৪২ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে ৪ গুণ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাবে জাল-জালিয়াতির ঘটনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে যেসব অর্থ বেরিয়ে গেছে সেগুলো এখন আদায় হচ্ছে না। ফলে ওইগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন বা রাইটঅফ করা হয়েছে।