স্টাফ রিপোর্টার: ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বিধি অনুযায়ী পরিচালিত সঞ্চয় স্কিম বা কর্মসূচির সুদের হার কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করেছে সরকার, যা গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। হঠাৎ করে বড় ধরনের মুনাফা কমানোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা। সাধারণ মানুষ, অবসরভোগী, সঞ্চয়প্রবণ নারীদের প্রশ্ন, তারা এখন কোথায় যাবেন? সন্তানের স্কুলের বেতন কীভাবে দেবেন? ওষুধ খরচ কই পাবেন? মাসিক চলার খরচ জোগাবেন কোথা থেকে? মুনাফার জন্য শেষ ভরসার জায়গাটাই থাকলো না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত: সাধারণ মানুষই ডাকঘরের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করেন। এর মধ্যে যারা অবসর নিয়েছেন, গৃহিণী তারাই বেশি। আর এই সঞ্চয় কর্মসূচি শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই বেশি জনপ্রিয়। এখন এই মানুষগুলোর অর্থ জমার জায়গা সীমিত হয়ে গেল। কারণ, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কিছুটা বেশি এবং নিরাপদ।
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত ও গৃহিণীদের ক্ষেত্রে এমন সঞ্চয়ে বিশেষ সুদহার থাকা উচিৎ। তাদের আশঙ্কা, নিরাপদ এ বিনিয়োগ মাধ্যমে মুনাফা কমায় গ্রামাঞ্চলে বাড়তে পারে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য। তাদের মতে, শহুরে প্রভাবশালীরা ডাকঘরে অর্থ রাখেন না বলে এর পক্ষে বলারও কেউ নেই। আর এতে বিপাকে পড়বেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা।
জানা গেছে, বর্তমানে ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক, পরিবার ও পেনশনার-এই চার ধরনের জাতীয় সঞ্চয় স্কিম রয়েছে। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক সরকারের জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের বাইরে। যদিও এসব স্কিমের ধরণ প্রায় একই রকম। এ ছাড়া সব ধরনের সঞ্চয়পত্র বাংলাদেশ ব্যাংক, সব বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সঞ্চয় অধিদপ্তরের অফিসের পাশাপাশি ডাকঘর থেকেও কেনা যায়।
ডাক অধিদফতরসূত্রে জানা গেছে, ডাকঘরে ৪ ভাবে টাকা রাখা যায়। ডাকঘর থেকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাব (অ্যাকাউন্ট) ও সাধারণ হিসাব খোলা যায়। আবার ডাকজীবন বীমাও করা যায়। এবার সুদের হার কমেছে ডাকঘরের সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদি হিসাব ও সাধারণ হিসাবে। ডাকঘর সঞ্চয়ে এক বছর, দুই বছর ও সাধারণ হিসাবেও সুদহার কমানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।
নতুন হার অনুযায়ী, সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার ৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ, তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা ছিল ১১.২৮ শতাংশ ছিল। তবে মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ পাওয়া যাবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০.২ শতাংশ। এ ছাড়া দুই বছরের ক্ষেত্রে তা হবে ৫.৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০.৭ শতাংশ।
ডাক অধিদফতরের কর্মকর্তা বলেন, তাদের এই সঞ্চয় স্কিম জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের একটি পণ্য। তবে প্রতিনিধি হিসেবে এটি পরিচালনা করে ডাক অধিদপ্তর। তিনি বলেন, স্কিমটির মেয়াদ আসলে তিন বছর। একজন ব্যক্তি একই নামে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা রাখতে পারেন। যৌথ হিসাবে জমা রাখা যায় ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে আগে ভাঙিয়ে ফেললেও নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, অর্থ মন্ত্রণালয় রোববার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকার কমায়নি, কমেছে ডাকঘরে যে সঞ্চয় কর্মসূচি (স্কিম) রয়েছে এবং সেই কর্মসূচির আওতায় মানুষ যে আমানত রাখছে তার সুদের হার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র সেই আগের মতোই আছে।
গুলিস্তানে অবস্থিত ডাকঘর অধিদপ্তরে সরজমিন দেখা গেছে, বেশ কিছু মানুষ ঘোরা-ফেরা করছেন। কথা বলার সময় তাদের অনেককে ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক প্রসঙ্গে গাজীপুর জেলার বাসিন্দা বাবুল হোসেন, গত দুই দশক ধরে আমি ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক টাকা রাখি। অনেক কর্মচারী ঘুষ দাবি করেন। না দিলে হয়রানি করেন। প্রাপ্ত মুনাফা থেকে ৫% হারে যে উৎসে কর কেটে নেয়া হয় তার কোনো রসিদ দেয়া হয় না। নাবালক হিসাব কয়েক বছর আগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ ব্যাংকে ছাত্র-ছাত্রীদের হিসাব খোলা যায়। এর মধ্যে সরকার ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে সুদ হার কমিয়ে জঘন্য কাজ করেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, যারা দেশের টাকা লুটপাট করে খাচ্ছে তাদের কিচ্ছু করতে পারছে না, স্বল্প আয়ের মানুষের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে সরকার, কারণ তাদের এখন আর ভোট লাগে না- ভোট এমনি হয়ে যায়।
আরেকজন বলেন, ঋণখেলাপিদের কিছু করতে পারছে না সরকার। ব্যাংক লুটকরাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের ওপর যতো নজরদারি। সারাজীবনের সঞ্চয়কৃত টাকা শেয়ারবাজারে খাটালেও ভরসা পাওয়া যায় না। কিন্তু ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচিতে টাকা রেখে অন্তত মুনাফা তুলে সংসার চালানো যেতো। সেটাও এখন আর সম্ভব হবে না।
পাশেই আরেকজন জানান, ঋণখেলাপিদের কিছু করবে কিভাবে? ওইসব চোরবাটপারদেরই তো বসানো হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। তারাই সিদ্ধান্ত দেয়।
ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল খন্দকার শাহনূর সাব্বির বলেন, সরকারে এখানে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। দুইটি প্রোডাক্টে এ পরিবর্তন করা হয়েছে। সেটা হলো একটা সাধারণ হিসাব অন্যটা মেয়াদি হিসাব। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে সরকারের কোনো নির্দেশনা এখনো দেখিনি।
এদিকে সঞ্চয়পত্রে ১ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে টিআইএন বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি অনলাইন পদ্ধতি চালুর পর চলতি বছরে বিক্রির গতি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে আগেরবারের একই সময়ের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭৩ শতাংশ। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৩২০ কোটি ৬২ লাখ টাকার। আগের বছর একই মাসে বিক্রি হয় ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।
গ্রাহকদের সুদ দিতে এখন আর সরকারকে বেশি টাকা গুনতে হবে না। আর সরকার ঠিকই এখন তার টাকার প্রয়োজন মিটিয়ে নিচ্ছে সঞ্চয়পত্রের চেয়েও স্বল্প সুদের জায়গা ব্যাংক থেকে ধার করে।
এদিকে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে, ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে ৯ শতাংশ সুদে তা ঋণ হিসেবে প্রদান করবে। মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কিছু কম আছে। পণ্যমূল্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাহলে ব্যাংকে টাকা রাখলে মুনাফা বাড়বে না।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আপনি ১০০ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে বছর শেষে ১০৬ টাকা পেলেন। মূল্যস্ফীতির কারণে আপনার ওই ১০০ টাকার মূল্যমানও কিন্তু ৬ টাকা কমে গেল, তাহলে টাকা বাড়লো কই? আমানতের সুদ যদি ১০ শতাংশ হতো, তাহলে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলেও আপনার জমা টাকার প্রকৃত পরিমাণ ৪ শতাংশ বাড়তো।
কিন্তু ডাকঘরের সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদে টাকা রাখলে ১১.২৮ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যেত। ১ লাখ টাকা জমা রাখলে ৩ বছর শেষ উৎসে কর কাটার পর হাতে পাওয়া যেত ৩০ হাজার ৪৫৬ টাকা। কিন্তু সেই পথটাও বন্ধ হয়ে গেল। নতুন সুদ কাঠামোতে গ্রাহকরা হিসাবের ধরণ অনুযায়ী আগের তুলনায় ৩৩ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা কম পাবেন। যা হতাশ করেছে আমানতকারীদের।
আমানতকারী ফয়সাল বলেন, আমি দেশের বাহিরে ছিলাম। দেশে এসেছে কিছু টাকা ডাকঘরে রেখে সংসার চালাতাম। কিন্তু সরকার সুদ হার কমালো। এখন কিভাবে সংসার চালাবো বুঝতে পারছি না। ষাটোর্ধ্ব রহিম মিয়া জানান, জমি বিক্রি করে কিছু টাকা এখানে রেখেছি। সরকার এখানেও হাত দিয়েছে। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ডাকঘরে যে সঞ্চয় করছে সেই সুদের হার যদি কমে তাহলে গ্রামে-গঞ্জে ইনফরমাল যে সুদপ্রদানকারীরা আছে তাদের কাছে এ অর্থ চলে যাবে। এজন্য বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত ও গৃহিণীদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ে বিশেষ সুদ হার থাকা উচিত। তাদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
অনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় এমনিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এ অবস্থায় মানুষের সাধারণ আয়ের সুযোগ কমে এলে সঙ্কট আরও বাড়বে।