লোকবল সংকটসহ নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে চুয়াডাঙ্গার ৬টি রেলওয়ে স্টেশন

কর্তৃপক্ষের দেয়া আশ্বাস দেখেনি আলোর মুখ
জহির রায়হান সোহাগ: স্বাধীনতার সূতিকাগার চুয়াডাঙ্গা। স্বাধীনতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে প্রথম রাজধানী চুয়াডাঙ্গার রেলওয়ে স্টেশনগুলো। কিন্তু লোকবল সংকটসহ নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ৬ স্টেশন। রাতে এসব স্টেশনে বাড়ছে মাদককারবারি ও মাদকাসক্তদের আনাগোনা। বৃদ্ধি পাচ্ছে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ। গেটম্যান না থাকায় অরক্ষিত রেল ক্রসিংগুলোতে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে তাঁজা প্রাণ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দেয়া আশ্বাস এখনও দেখেনি আলোর মুখ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ভারতের তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে মূলত বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। সে সময় চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জগতী পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপিত হয়। ১৮৯৭ সালে সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয় দর্শনা-পোড়াদহ সেকশনটি। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪০ কিলোমিটার রেলপথে ১০ স্টেশন রয়েছে। খুলনা-ঢাকা, খুলনা-রাজশাহী, খুলনা-সৈয়দপুর এ তিনটি রুটে ১৪ টি আন্তঃনগর, ৬টি লোকাল ও ২টি মৈত্রী ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনে প্রতিদিন যাতায়াত করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ এ তিন জেলার প্রায় আড়াই হাজার যাত্রী। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে আলমডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ, মোমিনপুর, জয়রামপুর, উথলী ও আনসারবাড়িয়া এ ৬টি স্টেশন। নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের একমাত্র দোতলা আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের কার্যক্রম। কোন ট্রেন কখন আসবে তা জানতে পারেন না যাত্রীরা। একই অবস্থা জেলার আনসারবাড়িয়া স্টেশনসহ আরও ৪টি স্টেশনের। এতে ট্রেনে যাতায়াত ও টিকেট কাটা নিয়ে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। স্টেশন বন্ধ থাকায় বিনা টিকেটে ট্রেন ভ্রমণ করে থাকে যাত্রীরা। ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিটি রেল স্টেশনে একজন স্টেশন মাস্টার ও সহকারী মাস্টার এবং চারজন করে পয়েন্টম্যান থাকার কথা। কিন্তু এসব স্টেশনে কেউ নেই। এ কারণে রাতে ট্রেনের চালককে সংকেত দেয়া, যাত্রীদের সহায়তা করা ও টিকেট সরবরাহের কাজ বন্ধ রয়েছে। অনলাইনে টিকেট কেটে টিকেট কালোবাজারি করছে একটি চক্র। জনবল না থাকায় রাতে এসব স্টেশনে বাড়ছে মাদককারবারি ও সেবীদের আনাগোনা। বৃদ্ধি পাচ্ছে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ। হচ্ছে অনৈতিক কাজও। বিশ্রামাগার বন্ধ থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন যাত্রীরা। অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন স্টেশনে যাত্রী সেবার মান নিম্নমুখী হওয়ায় রেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা।
সঠিক তদারকি না থাকায় নষ্ট হচ্ছে স্টেশনের মূল্যবান সরঞ্জাম। হচ্ছে চুরিও। দখল হয়েছে রেলওয়ের সম্পত্তি। ১০০ এর অধিক লেভেল ক্রসিং থাকলেও মাত্র ২৮টিতে রয়েছে ২৫ জন গেটম্যান। গেটম্যান নেই অধিকাংশ রেল ক্রসিংয়ে। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব রেলক্রসিং পারাপার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে, গত ১ বছরে ঠিক কতোজন ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন? চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই।
অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেও কোনো লাভ হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। আলমডাঙ্গা স্টেশন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মতিয়ার রহমান ফারুক জানান, আলমডাঙ্গা স্টেশনটি দেশের একমাত্র দোতলা স্টেশন। কয়েক বছর আগেও স্টেশনটির কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু কয়েক বছর থেকে স্টেশন মাস্টারসহ জনবল সংকট থাকায় প্রায় অচল হয়ে গেছে স্টেশনটি।
অভিন্ন মন্তব্য করেন যুগ্মআহ্বায়ক নাজমুল হাসান মল্লিক লিমন বলেন, আলমডাঙ্গা স্টেশনটি এখন মৃতপ্রায়। রাত হলেই ভূতুড়ে হয়ে যায় পুরো স্টেশন। এতে মাদকাসক্তদের আনাগোনাসহ বাড়ে চুরি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ।
কথা হয় আনসারবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন রক্ষা ও সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক মহাসিন আলী খান, যুগ্ম-আহ্বায়ক শেখ আব্দুল ওয়াদুদ, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নবী চৌধুরী, আন্দুলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ শফিকুল ইসলাম মোক্তার, স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম মামুনসহ আরও অনেকের সাথে। তারা জানান, গত ৭ বছর থেকে বন্ধ রয়েছে আনসারবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের কার্যক্রম। ট্রেনগুলো সঠিক সিগনাল না পাওয়ায় স্টেশনের অদূরে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। লোকাল ট্রেনগুলো কয়েক মিনিটের জন্য থামে। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ভালোভাবে ট্রেন থেকে নামতে পারে না যাত্রীরা। ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে প্রায়ই আহত হন তারা। ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লেখাপড়া ও প্রয়োজনীয় কাজ করতে যেতে চুয়াডাঙ্গা থেকে ট্রেনে উঠতে হয় শিক্ষার্থীদের। আনসারবাড়িয়া স্টেশন থেকে এলাকার উৎপাদিত কৃষি পণ্য পাঠানো হতো ঢাকার কারওরান বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু স্টেশনের কার্যক্রম না থাকায় বিপাকে এখানকার কৃষকরা। সমস্যাগুলো বারবার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোনো লাভ হয়নি। প্রতিবার সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
জনবল সংকটের কারণে অধিকাংশ রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান চুয়াডাঙ্গা স্টেশন মাস্টার মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, জনবল সংকটের কারণে চুয়াডাঙ্গা জেলার ১০টি স্টেশনের মধ্যে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ৬টির। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে বলেও জানান তিনি। লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে স্টেশনগুলো অচিরেই চালু হবে বলে জানালেন বাংলাদেশ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশীর বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, জনবল ঘাটতির কারণে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ১২৬টি স্টেশনের মধ্যে ৪৮টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এই ৪৮টির মধ্যে রয়েছে চুয়াডাঙ্গার ৬টি স্টেশন। আমাদের জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০ জন স্টেশন মাস্টার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোতে পাঠানো হবে। দ্রুত সমস্যার সমাধান করে স্টেশনগুলো সচল করার দাবি স্থানীয়দের।