করোনা ভাইরাস : মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্তে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মেডিকেল টিম গঠন

স্টাফ রিপোর্টার: করোনা ভাইরাসে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চীনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪১ থেকে বেড়ে ৫৬ জনে দাঁড়িয়েছে। নতুন এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১ হাজার ৯৭৫ জন আক্রান্ত হয়েছে। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে ভাইরাসটি যাতে মহামারি হয়ে না ওঠে সে ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সজাগ দৃষ্টি রাখছে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। একাধিক শহরে ঢোকা এবং শহর থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। রোববার থেকে উহানের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই ভাইরাস মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেন, উপসর্গ অনুযায়ী যেকোনো ডাক্তার চিকিৎসা দিতে পারেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনা জটিল। এদিকে চুয়াডাঙ্গায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সতর্কতামূলক প্রস্তুতির জন্য ৬ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। মেডিকেল টিম দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে আসা ও যাওয়া নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় রয়েছে আন্তর্জাতিক রেল স্টেশন ও জয়নগর চেকপোস্ট। জয়নগর চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা আসা-যাওয়া করেন। রোববার সকাল ১০টা থেকে জয়নগর চেকপোস্টে মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে। চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে দর্শনা জয়নগর চেকপোস্ট এলাকায় একটি মেডিকেল টিম দুই দেশ থেকে আসা নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। প্রতিদিন জয়নগর চেকপোস্ট দিয়ে আসা যাওয়া করে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সতর্কতামূলক প্রস্তুতির জন্য এ মেডিকেল টিম কাজ করছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শাকিল আরসালানকে প্রধান করে এ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ভারত থেকে আসা দুই দেশের নাগরিকরা বলছেন কোনো নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবেশের পর আমাদের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা কাস্টমস জয়নগর চেকপোস্টে দায়িত্বরত শেখ আব্দুল হাদি জানান, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কর্তৃপক্ষ আমাদের নির্দেশ দিয়েছে। চীন থেকে আসা যাত্রীদের প্রতি নজর রাখা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শাকিল আরসালান বলেন, মেডিকেল টিম কাজ করছে। চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াত করা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন এ, এস, এম মারুফ হাসান বলেন, সড়ক ও রেলপথে দুই দেশের যাত্রীরা বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাওয়া করেন। মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। আমাদের দেশে এ ভাইরাস আসার সম্ভবনা খুব কম।
অপরদিকে, চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসে নতুন করে ৩২৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। ভাইরাসটি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ায় এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, চীন ভয়াবহ ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারব বলে বিশ্বাস করি।
এখন পর্যন্ত ভাইরাসে মারা যাওয়া সব ঘটনাগুলোই চীনে। তবে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করা গেছে। এছাড়া শনিবার কানাডার ওন্টারিওতে প্রথম একজনের শরীরে করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে ভাইরাসটি একজন মানুষের মাধ্যমে আরেকজনের শরীরে ছড়াচ্ছে। এটি উহানের একটি বাজার থেকে উদ্ভূত হয়েছিলো, যেখানে অবৈধভাবে ধরে আনা বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায় বলে বিশ্বাস স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। বন্যপ্রাণীগুলো বিক্রি করার জন্য ধরে আনা হতো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই সপ্তাহে ‘চীনে জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, তবে বিষয়টিকে এখনো আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ শুক্রবার সন্ধ্যায় ইউরোপে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে। ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার শহর ও মধ্য হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উহানের বিমানবন্দরে সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। শহর থেকে বেরিয়ে আসা প্রধান রাস্তাগুলো চেকপয়েন্ট দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। চলমান পর্যবেক্ষণ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কর্তৃপক্ষ উহানের নিকটবর্তী ১০টিরও বেশি শহরকে বাইরে থেকে একইভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। উহান পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর, ফার্মেসিগুলোর সরবরাহ শেষ হয়ে যেতে শুরু করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা হাসপাতালগুলো ভরে গেছে। আজ সোমবারের মধ্যে শহরটিতে এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট নতুন হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু করছে বলে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। এ ছাড়া আগামী ১০ দিনের মধ্যে শুধু করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে দুটি নতুন হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে। যেখানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে। হুবেইয়ের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখানে আক্রান্ত ৬৫৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে। যাদের মধ্যে ৫৭ জনের অবস্থা গুরুতর। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা স্টাডিজের লিবার্থাল-রোজেল সেন্টারের পরিচালক মেরি গ্যালাঘার বলেছেন, এটা অবশ্যই বিভ্রান্তকর ও বিপর্যয়কর, প্রথমে সরকার নাগরিকদের আশ্বাস দিয়েছিল যে, ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে না এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারপর মাত্র চার দিন পরে উহান ও অন্যান্য শহরগুলোকে অভূতপূর্বভাবে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কারণ এর সম্পর্কে এখনও অনেক অজানা বিষয় রয়েছে। যেমন, এটি কতটা বিপজ্জনক এবং এটি কত সহজেই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শনিবার থেকে শুরু হওয়া চন্দ্র নববর্ষের সপ্তাহব্যাপী ছুটির দিনে কয়েক মিলিয়ন চীনা দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করার কারণে সংক্রমণ হার দ্রুত হতে পারে বলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। এই অবস্থায় ভাইরাস আরো বেশি ছড়িয়ে পরতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সে কারণে নববর্ষের অনেক অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করায় চীনা কর্তৃপক্ষ উহান থেকে চলাচলকারী সব যানবহন বন্ধ ঘোষণা করেছে। হুবেই প্রদেশে ভ্রমণে কড়া সতর্কতা জারি করেছে দেশটির সরকার। বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরগুলো চীন থেকে আসা যাত্রীদের ভাইরাস শনাক্তে স্ক্রিনিংয়ের কাজ বাড়িয়েছে, যদিও কিছু স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা এই জাতীয় স্ক্রিনিংয়ের কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। উহান শহরে সব বাস, মেট্রো এবং ফেরি চলাচল বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে শহর থেকে সব ফ্লাইট ও রেল সেবা বাতিল হয়েছে। ইঝু শহরে রেল স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ইনসি শহরে সব বাস সেবা বাতিল করা হয়েছে। যারা উহান শহর থেকে ফিরেছেন তাদের অন্তত ১৪ দিন বাড়িতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে বেইজিং ও সাংহাই কর্তৃপক্ষ। এই ভাইরাস যেনো ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উহান শহরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের বসবাস। মূলত ওই শহরে প্রাদুর্ভাব ঘটার পর ভাইরাসটি রাজধানী বেইজিংসহ অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।