স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানী ঢাকার পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা মামলায় ১০ জঙ্গিকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদ-ের পাশাপাশি আসামিদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় দু’জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
সোমবার ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. রবিউল আলম এ রায় ঘোষণা করেন। বোমা হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলায় এ রায় দেয়া হয়। ২০০১ সালে যে দিনটিতে বোমা হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছিলো, ১৯ বছর পর সেই একই তারিখে রায় দিলেন আদালত। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা চালানো হয়।
এ মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মুফতি মাঈনুদ্দিন শেখ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, আরিফ হাসান সুমন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুস্তাকিম, আনিসুল মুরসালিন, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও নুরুল ইসলাম। আসামিদের মধ্যে প্রথম চারজন ছাড়া বাকিরা পলাতক। হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানও ছিলেন এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি।
অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এখান থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত চার আসামিকে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মৃত্যুদ-ের রায় শুনে তাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি।
তারা কোনো কথাও বলেননি। রায়ের পর তাদের সাজার পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মশিউর রহমান ও রফিকুল ইসলাম মেরাজকে খালাস দেয়া হয়েছে। আর খালাস পাওয়া দু’জনকে সিপিবির সদস্য বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মো. আব্দুল্লাহ আবু ও সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সালাউদ্দিন হাওলাদার রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। রায়ে আসামিদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিন্তু ইন্ধনদাতা রাজনৈতিক শক্তিকে চিহ্নিত করা হয়নি বলে কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও অভিযোগপত্র দাখিলকারী সিআইডির পরিদর্শক মৃণাল কান্তি সাহা বলেন, রায়ে আমি সন্তুষ্ট। পত্রিকায় হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্যের দায় স্বীকার করে দেয়া বক্তব্যের সূত্র ধরেই এ মামলায় অধিকতর তদন্ত শুরু করি। শেষ পর্যন্ত জড়িত আসামিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ও শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট।
২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলায় পাঁচজন নিহত হন। আহত হয়েছিলেন অর্ধশতাধিক। ওই হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন সিপিবি নেতা হিমাংশু ম-ল, আবদুল মজিদ, আবুল হাশেম ও মুক্তার হোসেন। আর আহত হওয়ার ১৩ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিপ্রসাদ।
দীর্ঘ ১৯ বছর পর এ মামলার রায় হল। এদিন (সোমবার) রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই আদালতপাড়ায় নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। সবাইকে তল্লাশি করে তারপর আদালতে ঢুকতে দেয়া হয়। সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে বিচারক এ মামলার রায় পাঠ শুরু করেন। ১০৪ পাতার এ রায়ে মামলার পটভূমি, সাক্ষ্য-প্রমাণ, যুক্তিতর্ক, মেডিকেল রিপোর্ট, ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা ও কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যাসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন বিচারক। বেলা ১১টা ১৫ মিনিটের দিকে সংক্ষিপ্ত রায় পাঠ শেষ করেন বিচারক।
রায়ে পর্যবেক্ষণ : রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আসামিরা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) সদস্য। তাদের (আসামি) ধারণা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক, ইমলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়, ইসলামের শত্রু এবং আল্লাহ-খোদা মানে না।
সে কারণে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আসামিরা ওই বোমা হামলা ঘটিয়েছে। এছাড়াও তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং বিব্রত করার জন্য এ বোমা হামলা ঘটানো হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আসামিদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাসহ বিস্ফোরক আইনে মামলা রয়েছে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। আসামিরা আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জ জেলার নেতা শামীম ওসমান এমপির অফিসে বোমা হামলা ও রমনার বটমূলে বোমা হামলা মামলার আসামি। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বোমা হামলা অর্থাৎ ২১ আগস্ট বোমা হামলা মামলারও আসামি।
আসামিদের প্রতিটি বোমা হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ মারা গেছে। আসামিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নসাৎ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
সে কারণে এ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং সমুন্নত রাখার জন্য হরকাতুল জিহাদের এ জঙ্গিদের (আসামি) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। ইসলাম ধর্ম শান্তি ও সত্যের ধর্ম। কোনো জঙ্গি সংগঠন বা কোনো দলকে ধর্মের নামে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে হত্যা করার কোনো অধিকার প্রদান করেনি আমাদের ধর্ম।
১৯ বছরের অপেক্ষা : ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির লাল পতাকা সমাবেশে এ বোমা হামলা হয়েছিলো। এ ঘটনায় দলটির তৎকালীন সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান বাদী হয়ে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় এ মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট (আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে প্রতিবেদন) দেয় পুলিশ।
এরপর ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের আগস্টে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা হয়। এসব ঘটনায় জঙ্গিরা জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়ার পর ফের এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। সাত কর্মকর্তার হাত ঘুরে মামলার তদন্তভার পান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক মৃণাল কান্তি।
তদন্তকালে তিনি আসামি মুফতি মাঈনুদ্দিন শেখকে গ্রেফতার করেন। মাঈনুদ্দিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে জানান, এ ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হুজি জড়িত। অন্যদিকে আসামি মুফতি আবদুল হান্নান ২০০৬ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে জানান, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় তার দল হুজি জড়িত।
দীর্ঘ পুনঃতদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ১৩ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়। এরপর হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট ও বিস্ফোরক মামলায় ৪ সেপ্টেম্বর ওই ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন আদালত। এরপর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
হত্যা মামলায় ১০৭ জনের মধ্যে ৩৭ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১ ডিসেম্বর মামলায় আসামিপক্ষে ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার এদিন ধার্য করেন আদালত। অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি অদ্যাবধি বিচারাধীন রয়েছে।