পেছালো এসএসসি পরীক্ষা ও ঢাকা সিটি ভোটের দিন

পূজার দিনে ভোট না করার জোরালো দাবির মুখে পিছু হটলো নির্বাচন কমিশন

স্টাফ রিপোর্টার: সরস্বতী পূজার দিনে ভোট না করার জোরালো দাবির মুখে পিছু হটে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ পরিবর্তন করেছে নির্বাচন কমিশন। পুননির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে ১ ফেব্রুয়ারি। শনিবার সিইসি কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের জরুরি সভায় নতুন তারিখ ঠিক হয়। এদিকে সিটি নির্বাচনের ভোট পেছানোয় এসএসসি পরীক্ষাও পিছিয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে এখন ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অনশন ভেঙেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাতে অনশন কর্মসূচি থেকে সরে এসে তারা আন্দোলন সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
৩০ জানুয়ারি ভোটের দিন রেখে ২২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলো ইসি। ওই দিন সরস্বতী পূজা বলে তফসিল ঘোষণার পরপরই এর বিরোধিতা করেছিলো পূজা উদযাপন পরিষদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদও ভোটের দিন পরিবর্তনের দাবি জানায়। কিন্তু তা আমলে নেয়নি ইসি। এর মধ্যে ভোটের তারিখ পরিবর্তনে হাইকোর্টে রিট আবেদন হলে তা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ইসি ৩০ জানুয়ারি ভোট করার বিষয়ে আরও শক্ত অবস্থান নেয়। ইসির পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছিলো, ৩০ জানুয়ারিই ভোটগ্রহণের জন্য ‘উপযুক্ত’ দিন। কারণ তার পরের দিন ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার বলে সেদিন ভোটগ্রহণের নজির নেই। এরপর ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে বলে প্রায় এক মাস আর ভোট করা যাবে না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী অনশন শুরু এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কর্মসূচি ঘোষণা করলে ভোটের দিন বদলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও সিপিবিসহ রাজনৈতিক দলগুলো জানায়, ভোটের তারিখ পরিবর্তনে তাদের আপত্তি নেই। প্রধান প্রার্থীরাও ভোটের তারিখ পরিবর্তনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে ইসিকে আহ্বান জানায়। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে অযৌক্তিক বললেও তাদের পক্ষে জনমত জোরালো হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে শনিবার আকস্মিকভাবে জরুরি বৈঠকে বসে ইসি। বৈঠকে অংশ নিতে নির্বাচন কমিশনারদের টেলিফোনে ডেকে নেয়া হয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বৈঠকে উপস্থিত হতে প্রথমে বলা হলেও পরে তাদের না ডেকে মতামত নেয়া হয়। বৈঠকের আগে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সবকিছু বিবেচনা করেই তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
শনিবার রাতে নির্বাচন কমিশনের জরুরি বৈঠকে ভোটের পরিবর্তিত তারিখ নির্ধারণ করা হয়। অনেকটা আকস্মিক নির্বাচন কমিশনের সভা ডেকে দুই দফায় প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর ভোট পেছানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে সাংবাদিকদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা ভোট পেছানোর কথা জানান। নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পিছিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি শুরুর ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তার ঘোষণা দেয়ার পর কিছু সময় পর সাংবাদিকদের সামনে আসেন সিইসি। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতিতে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ব্যাঘাত না আসে সেটা বিবেচনা করে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও তার দফতরে বসে দাফতরিক প্রস্তুতি নিয়ে তাকে জানিয়েছেন। ১ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষা পিছিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ১ ফেব্রুয়ারি দিনটি মুক্ত হিসেবে পাওয়া গেছে। এ কারণে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতিতে ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নিজ সিদ্ধান্তের পক্ষে আবার সাফাই গেয়ে সিইসি বলেন, সরকারি ক্যালেন্ডারে ২৯ জানুয়ারি সরস্বতী পূজা উল্লেখ আছে। ক্যালেন্ডারে ৩০ জানুয়ারি পূজার তারিখ উল্লেখ নেই। সেই প্রেক্ষাপটে ৩০ জানুয়ারি ভোটের দিন নির্ধারণ করেছিলাম। তফসিল ঘোষণার প্রথম থেকেই ভোটের তারিখ পেছানোর দাবি উঠেছিলো, তখন তা পরিবর্তন না করে এখন কোন গ্রাউন্ডে ভোট পেছানো হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, কোনো গ্রাউন্ড নেই।
নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, ভোটের তারিখ পেছানোর পর পুনঃতফসিল সংক্রান্ত চিঠি শনিবার রাতেই জারি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভোট পেছানোয় প্রার্থীরা বাড়তি দুই দিন প্রচারের সময় বেশি পাচ্ছেন। এর আগে শনিবার কমিশনের এক জরুরি সভা বিকাল সোয়া ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত (মাগরিবের বিরতিসহ) চলে। যদিও দাবি ওঠার শুরু থেকেই নির্বাচনের দিন পরিবর্তনের বিষয়ে এতদিন অনড় অবস্থানে ছিলো ইসি।
নির্বাচন পেছানোর দাবিতে দু’সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন, ইসি ও আদালতে একের পর এক আবেদন এবং বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে ইসি এই সিদ্ধান্ত নিলো।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সরস্বতী পূজার কারণে ৩০ জানুয়ারি ভোটের তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু কমিশন তার অবস্থানেই অনড় ছিলো।
শনিবার রাতে নিজের হেয়ার রোডের বাসভবনে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দুইদিন পেছানো হয়েছে। তিনি বলেন, ১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে এ পরীক্ষা ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে। নতুন সময়সূচি অনুযায়ী গোটা পরীক্ষা নেয়া হবে। আগের সূচি অনুযায়ী ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তত্ত্বীয়, ৯ মার্চ পর্যন্ত ব্যবহারিক পরীক্ষা চলার কথা ছিলো। কিন্তু এখন গোটা সময়সূচি পুননির্ধারিত হবে। জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, এখন নতুন করে পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারিত করা হবে। নতুন সময়সূচি শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
অনশন ভাঙলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা : ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তৃতীয় দিনের অনশন ভেঙেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাতে অনশন কর্মসূচি সমাপ্ত ঘোষণা করেন তারা। এর আগে ৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের দাবিতে টানা তিনদিন অনশন করেন আন্দোলনকারীরা। এতে প্রায় ২০ শিক্ষার্থী অসুস্থ হন। তাদের মধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অন্যদের স্যালাইন দেয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের অনশন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা সংহতি জানান। তাদের মধ্যে ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মিহির লাল সাহা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক গোবিন্দ ম-ল, গণিত বিভাগের শিক্ষক নেপাল চন্দ্র রায়, চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ড. মুকুল কুমার বাড়ৈ প্রমুখ। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সংহতি জানান। অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীসহ ডাকসু ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন।
আন্দোলনের বিষয়ে জগন্নাথ হল সংসদের ভিপি উৎপল বিশ্বাস বলেন, আমরা ইসির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে আমাদের দাবি মানা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও জোরদার হবে। জগন্নাথ হলের জিএস কাজল দাস বলেন, নির্বাচনের দিন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। দাবি পূরণ হওয়ায় আমরা আন্দোলন সমাপ্ত ঘোষণা করছি।
এদিকে তৃতীয় দিনের কর্মসূচিতে বেলা ১২টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী অভিদাস প্রীতম। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। বাকিরা স্যালাইন লাগিয়ে অনশনস্থলে অবস্থান নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের ভিপি উৎপল বিশ্বাস, জিএস কাজল দাস, সমাজসেবা সম্পাদক প্রদীপ দাস, বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক অর্ণব হোড়, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অর্ক সাহা, বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অপূর্ব চক্রবর্তী, জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী দীপ্ত সাহা, জয়ন্ত বণিক, সবুজ কুমার, সুকেশ দেবনাথ, ভবতোষ চন্দ্র রায় ও মহসিন হলের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম রবিসহ বেশ কয়েকজন।