স্টাফ রিপোর্টার: গাইড বই নিষিদ্ধ। তবুও কোনো প্রকাশনী থেমে নেই। প্রশাসন বেশ কঠোর। গাইড বইসহ কোনো লাইব্রেরি বা স্কুলে কেউ ধরা পড়লে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রশাসন ও আইনকে তোয়াক্কা করছে না কেউ। মাঠে নেমেছে দালালচক্র। ওরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুষ প্রদান বাবদ ১০ কোটি টাকা বাজেট করেছে বলে জানা গেছে। দালালচক্র স্কুলের প্রধানশিক্ষক ও কমিটির সভাপতিকে ঘুষ দেয় ছাত্রসংখ্যা অনুসারে। সহায়ক বইয়ের নামে ডজন দুয়েক পাবলিকেশন কোটি টাকার নিষিদ্ধ নোট গাইড বিক্রির টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে গাইড বই শিক্ষার্থীদের ধরাতে শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে।
সূত্রমতে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতি ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকারও বেশি উৎকোচ দিচ্ছে পাবলিকেশনগুলো। গত ডিসেম্বর থেকে পাবলিকেশনের দেড়শ’ কর্মী প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক-সভাপতি ও বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে মোটা অংকের টাকার ছড়াছড়ি। চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় টাকা নিয়ে ছুটছেন নিষিদ্ধ গাইড সরবরাহকারী পাবলিকেশনগুলোর প্রতিনিধি। অর্থ হাতিয়ে শিক্ষার্থীদের গাইড কিনতে পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক শিক্ষক ও শিক্ষক নেতারা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে জেলা শিক্ষা অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিজিট করতে গেলে কোনো গাইড চোখে পড়ে না। আমরা যখন কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করি পাঠ্যপুস্তকের সাথে আর কোন ধরনের বই পড়ানো হয় কিনা। আমরা কোনোকিছু দেখি না। তবে স্কুলের বাইরে তারা এই গাইডগুলো ব্যবহার করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তিনি আরো বলেন, তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের ভয়ে লাইব্রেরিগুলো গাইড বই তাদের লাইব্রেরিতে না রেখে বাইরে কোনো গুদামে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। কেউ কিনতে গেলে একটু দাঁড়ান বলে গুদাম থেকে এনে দিচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মনিরা পারভীন বলেন, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত গাইড বই নিষেধ। গাইড বই বিক্রিকালে বা বিতরণকালে কোনো লাইব্রেরি বা স্কুলের কেউ ধরা পড়লে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন অনুসারে সাজা প্রদান করবে। আমরা খুব দ্রুতই এটা বাস্তবায়ন করবো। একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দু’একটি বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ বিষয় সৃজনশীল পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যা পরিহার, গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন করে। কিন্তু সরকারের এই প্রয়াস ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা করছে চিহ্নিত সব প্রকাশনী ও তাদের সহযোগী শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির কতিপয় নেতা। বিষয়টি নিয়ে নজরদারিতে মাঠে নেমেছে জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা অফিস। তবে কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল সূত্র ও বই ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছে, মূলত নোট গাইড চালাতে বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই চিহ্নিত প্রকাশনা কোম্পানির কর্মী বাহিনী মাঠে নেমে পড়েছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন লাইব্রেরিতেও মোটা অংকের কমিশন ও উপঢৌকন দিয়ে গাইড চালাচ্ছে। আর তা বিক্রি নিশ্চিত করতে এবার কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে টাকা ছড়ানোও শুরু হয়েছে। চিহ্নিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, এলাকার শিক্ষকনেতা এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা পর্যায়ে ম্যানেজ ও দেনদরবার চালাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, পুঁথিনিলয়ের অনুপম প্রকাশনী, পপি পাবলিকেশন, লেকচার পাবলিকেশন, গ্যালাক্সি, নিউটন পাবলিকেশন, স্কয়ার, আশার আলো পাবলিকেশন, পুঁথিঘর পাবলিকেশনের সংসদ, ফুলকুড়ি পাবলিকেশন, গ্যালাক্সি পাবলিকশনসহ কমপক্ষে দু’ডজন পাবলিকেশন মাঠে টাকা ছড়ানোর প্রতিযেগিতায় নেমেছে। এর মধ্যে অনুপম প্রকাশনী ১শ’ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টাকা সরবরাহ করেছে। স্কুলের ছাত্র অনুসারে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিচ্ছে এই প্রকাশনী। শহরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গাইড ধরাতে এক লাখ ২০ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়েছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। আশার আলো পাবলিকেশন প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গাইড ছাপিয়ে বাজারজাত করছে। মাঠ চষছে হাফডজন কর্মী। একইভাবে প্রত্যেক পাবলিকেশন জেলার প্রতিটি উপজেলায় লোক লাগিয়ে শিক্ষক ও স্কুল ধরতে ব্যস্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র গুনে প্রধান শিক্ষকের হাতে মাথা প্রতি ৪০ টাকা ও মাধ্যমিকে ছাত্র মাথাপ্রতি প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিকে ৭০ টাকা করে দেয়ার চুক্তি হচ্ছে বলে তথ্য এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতি এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিচ্ছে পাবলিকেশনগুলো। এতে শিক্ষকরা আর্থিক লাভবান হলেও মেধাশূন্য হতে যাচ্ছে শিক্ষার্থী। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কয়েকটি শিক্ষক সমিতি ইতোমধ্যে কয়েকটি পাবলিকেশনের কাছ থেকে টাকা গ্রহণও করেছে। গাইডের মান যাই হোক না কেনো, তা যে কোনো উপায়ে চালাতে ওই টাকা আগাম নিয়েছেন তারা।
স্থানীয় সূত্রের দাবি, পাবলিকেশনের প্রতিনিধিরা নমুনা গাইড নিয়ে বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেয়ারের পাশে বসে খোশগল্প করছেন এমন চিত্র চোখে পড়ছে প্রায়ই। তারা জানিয়েছেন, গাইডের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে পাবলিকেশনগুলো উৎকোচ দেয়া টাকা তুলে নিচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানির গাইড ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও জিম্মিদশায় পড়ে সন্তানের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে কষ্ট হলেও কিনতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। অভিভাবকদের অভিযোগ, শিক্ষাব্যবস্থা সৃজনশীল হলেও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের নিরবতার কারণে বই বাজার গাইডে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা বছর শুরুর প্রথম থেকেই বাজারে ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনীর চড়া মূল্যের কথিত এ গাইড শিক্ষার্থীদের কিনতে পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষকরা। শহর ও শহরতলীর কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বছরের শুরুতেই প্রকাশনীর লোকজন স্কুলে স্কুলে যাচ্ছেন। স্যারদের হাতে নমুনা বই দিচ্ছেন। ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে গাইড কিনতে নির্দেশনা দেন শিক্ষকরা। কয়েকজন অভিভাবকের অভিযোগ, শিক্ষক সমিতি থেকে উৎকোচের টাকা পেয়ে গাইড কিনতে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন স্কুলের শিক্ষকরা। সরকার শিশু শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বই দিলেও শিক্ষকরা তা পড়ান না। আর তারা শিশু শিক্ষার্থীদের গাইড কিনতে বলেন। একসেট গাইডের দামও তাদের মতো গরিব অভিভাবকদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। গাইড কেনার কারণে এনসিটিবির বইয়ের গুরুত্ব কমছে। এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসার শরীফুল ইসলাম বলেন, নোট বা গাইডবই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবুও এগুলো নারায়ণগঞ্জসহ দেশব্যাপী চলছে। গাইড বই বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে পারেন জেলা প্রশাসক মহোদয়। কোনো সহায়ক গাইড বা সহায়ক বই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো শিক্ষক গাইড বিক্রেতা বা প্রকাশনীর সাথে সখ্যতা গড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাঠ্য পুস্তকই হোক একমাত্র সহায়ক এ সেøাগানকে সামনে রেখে তিনি শিক্ষক অভিভাবক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের পথ চলার আহ্বান জানান।