জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের দায় স্বীকার : ফাঁসির দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ
স্টাফ রিপোর্টার: কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় মজনুকে (৩০) গ্রেফতার করেছে র্যাব। বুধবার ভোরে শেওড়া রেলক্রসিং এলাকা থেকে এই ধর্ষককে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ওই ছাত্রীর ব্যাগ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর র্যাবের কাছে সে ধর্ষণের দায় শিকার করে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে। র্যাব জানিয়েছে মজনু ‘সিরিয়াল রেপিস্ট। প্রতিবন্ধী-ভিক্ষুক নারীরাও মজনুর হাত থেকে রেহাই পায়নি। মানসিক প্রতিবন্ধীদের টার্গেট করে সে সুযোগ বুঝে তাদের ধর্ষণ করতো। ঘটনা ফাঁস না করতে তার শিকারদের হত্যার ভয় দেখাতো। কুর্মিটোলায় যেখানে ঢাবি ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সে, ঠিক একই জায়গায় আরও অনেক নারীর সম্ভ্রম কেড়েছে সে। মজনুই র্যাবকে এসব তথ্য দিয়েছে। বুধবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন-কাশেম এ তথ্য জানান।
এদিকে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে বুধবারও ঢাবি ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি থেকে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠে আসে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে বিদ্যমান আইন সংশোধনের দাবি জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ধর্ষককে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়ার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি নারীর জন্য নিরাপদ কর্মস্থল ও নগরী গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতার মজনু সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন-কাশেম বলেন, সে নিজেকে হকার দাবি করলেও চুরি-ছিনতাই ছিলো তার পেশা। আর ধর্ষণ ছিল মজনুর নেশা। তিনি বলেন, ঘটনার দিন সে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। এরপর সে কুর্মিটোলার ওই স্থানে ওঁৎ পেতে থাকে। এদিকে ঢাবি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস থেকে কুর্মিটোলায় নেমে ফুটপাত ধরে হেঁটে শেওড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। তাকে দেখে মজনু আলোড়িত হয়। সে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে ঝোপের আড়ালে নিয়ে যায়। সে বারবার ওই শিক্ষার্থীকে কিল-ঘুষি মারছিলো আর গলা চেপে হত্যার হুমকি দিচ্ছিলো। মজনু ওই শিক্ষার্থীকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। শিক্ষার্থীও এর মধ্যে কয়েকবার চেতনা হারিয়ে ফেলেন। শিক্ষার্থীর একপর্যায়ে চেতন ফিরলে তিনি তার বান্ধবীর বাসায় যান। এরপর সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সারোয়ার বিন কাসেম বলেন, ধর্ষণের পর মজনু ভিকটিমের ব্যাগ, মোবাইল ও পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশনের দিকে চলে যায়। সেখানে অরুণা বিশ্বাস নামে একজনের কাছে মোবাইলটি সে ৫শ’ টাকায় বিক্রি করে। এরপর ৪০০ টাকা নিয়ে সে ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে করে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে যায়। সেখান থেকে ট্রেনে নরসিংদী চলে যায়। রাতে নরসিংদী স্টেশনে ঘোরাফেরা করে। পরদিন সোমবার সকালে আবার ট্রেনে বনানী স্টেশনে আসে। তখন থেকে ওখানেই সে অবস্থান করছিলো।
এদিকে মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে ভাঙা থাকায় অরুণা বিশ্বাস রিকশাচালক খায়রুল নামের এক ব্যক্তির কাছে তা মেরামত করতে দেয়। র্যাব মোবাইলের সূত্র ধরে মঙ্গলবার প্রথমে খায়রুল ও পরে অরুণাকে আটক করে। অরুণার দেয়া তথ্য ও ভিকটিমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারি মজনুই ধর্ষক। এরপর তদন্ত করে দেখা যায়, মঙ্গলবার সারাদিন মজনু বনানী রেলস্টেশনে ছিলো। কড়া নজরদারিতে রেখে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে তাকে শেওড়া রেলক্রসিং এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় ওই ছাত্রীর ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও পাওয়ার ব্যাংক উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর ভিকটিমকে তার ছবি দেখানো হয়। বেশ কয়েকবার ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, আমি নিজেও কথা বলেছি। ভিকটিম বলেছেন, পৃথিবীর সব চেহারা ভুলে যেতে পারি, এই লোককে ভুলবো না।
সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মজনু বিভিন্ন সময় ধর্ষণের কথা অকপটে স্বীকার করে। তবে এসব বিষয়ে সে পুরোপুরি নির্বিকার। সে কয়েকবার ভিকটিমকে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলো। তবে ভাগ্য ভালো, আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
মজনু জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে সে একাই ছিলো। ভিকটিমও একই কথা বলেছে। মজনু জানিয়েছে, সে নিরক্ষর। ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে তার সামনের দুটি দাঁত ভেঙে যায়। তার বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ার জাহাজমারা গ্রামে। তার বাবা মৃত মাহফুজুর রহমান। সে ১০ বছর আগে ঢাকায় আসে। গ্রামের বাড়িতে মা থাকলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে সে আর বিয়ে করতে পারেনি। তাই সে এ ধরনের কাজ করতো। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ভিকটিম অজ্ঞান হলেও সে চেতনানাশক কিছু ব্যবহার করেনি বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। তার কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র পাইনি, এ ধরনের কথাও সে জানায়নি। তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে র্যাব-১ সহ একাধিক টিম টানা কাজ করে ধর্ষককে শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। মামলাটি যেহেতু ডিবির কাছে রয়েছে, আসামিকে ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হবে। তিনি জানান, খায়রুল ও অরুণাকেও ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরে মজনুসহ তিনজনকে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ছাত্রীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি: ওই ছাত্রীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। তিনি মানসিকভাবেও আরও শক্ত হয়েছেন। তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড দেখেছে। তাকে রিলিজ করা হবে কিনা সে বিষয়ে বৃহস্পতিবার বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি নিজেও এখানে আর থাকতে চাইছেন না।
ঢাবিতে বিক্ষোভ মানববন্ধন: রোববার ক্যাম্পাস থেকে রাজধানীর শেওড়ায় বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার হন ওই ছাত্রী। এর প্রতিবাদ এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বুধবার অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এতে একাত্মতা প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়ার পরিচালনায় এতে বক্তব্য রাখেন সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী, ইতিহাস বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক শরিফুল্লাহ ভূইয়া, গণিতের অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার, সিন্ডিকেট সদস্য হুমায়ুন কবির, কুয়েত মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ মাহবুবা নাসরিন প্রমুখ।
সংহতি জানিয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্যাতিত ছাত্রীর পাশে থেকে সব ধরনের সহায়তা করবে। ভিসি এই ধরনের পাশবিক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানে আইনি কাঠামোর মধ্যে কোথাও ঘাটতি থাকলে তা খতিয়ে দেখতে হবে। ছাত্রী ধর্ষণের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, তার জন্য সরকারকে অনুরোধ করবো।
ধর্ষকের ফাঁসি দাবি: ধর্ষণের ঘটনায় আটক ধর্ষকের জনসম্মুখে ফাঁসির দাবি উঠেছে। বুধবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের এক মানববন্ধন থেকে এমন দাবি উঠে আসে।
জনসম্মুখে ধর্ষকের ফাঁসির দাবি জানিয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আঁখি খানম বলেন, আমরা ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশে যে আইন রয়েছে তারও সংস্কারের প্রয়োজন বলে মনে করি। সংস্কার করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হোক যেনো ভবিষ্যতে কেউ ধর্ষণ করার আগে নিজের জীবনের যে ক্ষতি হবে তা নিয়ে ভাবতে পারে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার প্রভা বলেন, আমি র্যাবকে ধন্যবাদ জানাই। তারা আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ধর্ষককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। আমি ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। জনসম্মুখে ধর্ষককে ফাঁসি দেয়া হোক বলে উল্লেখ করে প্রভা আরও বলেন, এরকম শাস্তি নিশ্চিত করা হলে বাংলাদেশে আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে না।